ছাত্র–জনতার আন্দোলনে গুরুতর আহত ৩ শতাধিক এখনো চিকিৎসাধীন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হাবিবুল বাদশা। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে
ছবি: প্রথম আলো

হাবিবুল বাদশার চিকিৎসা চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। তার বয়স ১৭ বছর। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে সে আহত হয়। আগে ছিল কেবিনে, দুই দিন আগে এসেছে এই বিশেষ ওয়ার্ডে। এটি আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত বিশেষায়িত ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

হাবিবুলের মতো আন্দোলনের সময় গুরুতর আহত তিন শর বেশি রোগী এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এসব রোগীর চিকিৎসা দিতে যুক্তরাজ্য ও চীনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল ঢাকায় এসেছে। চোখে আঘাত পাওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্যও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা আসবেন।

গতকাল রোববার সকালে কথা হয় হাবিবুলের সঙ্গে। তার বাড়ি সিলেট শহরে। দিনে কাজ করত, আর রাতে একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ত।

জুলাইয়ের মাঝামাঝি নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় ফুফুর বাসায় বেড়াতে আসে। ২০ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে সে আহত হয়।

হাবিবুল বলে, তারা চারজন ছিল। একজন গুলিতে মারা যায়। গুলিতে তার বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে গুঁড়া হয়ে যায়। প্রথমে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কয়েক দিন পর জানতে পারে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা বিনা মূল্যে হবে। ২৩ আগস্ট যোগাযোগ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে আসে।

এখানে তার পরিবারের কোনো খরচ হচ্ছে না উল্লেখ করে হাবিবুল জানায়, ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবকিছুই করা হচ্ছে হাসপাতাল থেকে। শুধু সঙ্গে থাকা নানির খাবার তাদের কিনতে হয়। সরকার থেকে এখনো কোনো আর্থিক সাহায্য পায়নি, কী করে পাবে, তা-ও সে জানে না।

আন্দোলনের সময় হাবিবুলের মতো গুরুতর আহত ৩৯ জন রোগী গতকাল পর্যন্ত ভর্তি ছিলেন বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

গুরুতর আহতরাই হাসপাতালে

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় সহিংসতা-সংঘর্ষে সারা দেশে ২১ হাজার ৮০০ জনের বেশি আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর আহত ছিলেন অর্থাৎ অঙ্গহানি হয়েছে বা এর ঝুঁকি আছে ৫২৫ জনের।

গতকাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি ছিল সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ১৩৫ জন। ৬৭ জন ভর্তি ছিলেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল)। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ৪৩ জন, ঢাকা মেডিকেলে ৩৯ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ জন, ন্যাশনাল নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ৭ জন ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৪ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এসব হাসপাতালের পরিচালক বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, চিকিৎসার ছোট-বড় কোনো খরচ রোগীকে বহন করতে হচ্ছে না।

যেসব রোগী ভর্তি আছেন, তাঁদের সবারই এক বা একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাঁদের একজন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আবদুল্লাহ আহমেদ। গতকাল পঙ্গু হাসপাতালে কথা হয় ১৮ বছর বয়সী এই তরুণ ও তাঁর বাবা শাহদাৎ হোসেন মোল্লার সঙ্গে।

ছেলে ও বাবার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৪ আগস্ট দুপুরে মিরপুর বিআরটিএর সামনে পুলিশের গাড়ি চাপা দেয় আবদুল্লাহকে। ঢাকার কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা না-ও হতে পারে—এই আশঙ্কায় শাহদাৎ হোসেন আহত ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর চলে যান। একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। এরপর ৭ আগস্ট আবদুল্লাহকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শাহদাৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল্লাহর পায়ে তিনবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। অনেক ওষুধ লেগেছে। হাসপাতালের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে সব খরচ বহন করা হয়েছে। তাঁদের কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হয়নি।

ঢাকা মেডিকেলে ও পঙ্গু হাসপাতালে আরও ছয়জন রোগী বা তাঁদের স্বজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, চিকিৎসার জন্য কোনো খরচ হচ্ছে না। তবে দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকার কারণে অনেকের সংসার অচল হয়ে পড়ছে।

পঙ্গু হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, হাড় ভাঙার পাশাপাশি যদি মাংসে ক্ষত থাকে, তা হলে চিকিৎসা দীর্ঘায়িত হয়। প্রথমে ক্ষত ভালো করতে হয় বা শুকাতে হয়, তারপর ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা হয়। এসব করতে একাধিকবার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।

সহায়তায় বিদেশি চিকিৎসক

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গতকাল দুপুরে চীন থেকে ১০ সদস্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল ঢাকায় এসেছে। তাঁরা পঙ্গু হাসপাতালসহ একাধিক হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করবেন। প্রয়োজনে আরও বড় চিকিৎসক দল বাংলাদেশে আসবে।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে চোখে আঘাত পাওয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য নেপাল থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আনার আলোচনা চলছে। তাঁরা মূলত কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করবেন বলে জানা গেছে। গতকাল জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক আবুল খায়ের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আজই (রোববার) নেপালি চিকিৎসকদের সঙ্গে অনলাইনে মিটিং করেছি। ৪০টি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হবে বলে আমরা ধারণা করছি। খুব শিগগির তাঁরা যেন বাংলাদেশে আসতে পারেন, সেই প্রস্তুতি চলছে।’

আছে কিছু অভিযোগ

১৯ সেপ্টেম্বর বেলা একটায় সচিবালয়ের ১ নম্বর ফটকের সামনে ১০-১২ জনের একটি জটলা চোখে পড়ে। কাছে গিয়ে জানা গেল, তাঁরা প্রত্যেকে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় আহত হয়েছেন। তাঁদের সঠিক বা পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হয়নি, এই অভিযোগে তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তুলে ধরতে চান।

দুই দিন পর ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে তাঁরাসহ আরও ৫০-৬০ জন আহত ব্যক্তি ড. ইউনূসের সরকারি বাসভবনের সামনে জড়ো হন। একপর্যায়ে তাঁদের পাঁচজনের একটি প্রতিনিধিদল ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন।

ওই দলে ছিলেন সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ। রাজধানীর বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। বাড়ি চট্টগ্রামে। ৫ আগস্ট বিকেলে চট্টগ্রামের পুলিশ লাইনসের কাছে ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ছররা গুলি ছোড়ে। অনেকের সঙ্গে তিনিও আহত হন। ছররা গুলি লাগে তাঁর মাথা, মুখ ও চোখে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাঁচটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই মাসে অনেকে ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে পারেননি, পূর্ণাঙ্গ বা পরিপূর্ণ চিকিৎসা হয়নি। এখন তাঁদের অনেকেরই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাঁদের সংখ্যা অনেক। এঁরা যেন পরিপূর্ণ চিকিৎসা পান, সেই বিষয়টি তুলে ধরার জন্য আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করি।’

আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য কাজ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য উপকমিটি। এই উপকমিটির সদস্য আবদুল মুনিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কারও সাক্ষাৎকারের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তবে আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন।