প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com
২০১১ সাল। বছর তিনেক হলো একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করছি। কিছু পেশাগত কোর্স করার সুযোগ খুঁজছিলাম। অবশেষে জাপানের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ে ওসাকায় তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণে যাওয়ার সুযোগ হলো। আমার স্যার গাঁইগুঁই করছিলেন। যদি ফিরে না আসি! মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। জীবনে প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছি, তা–ও জাপানের মতো দেশে।
ঢাকা থেকে রাত তিনটার ফ্লাইটে হংকং ও তাইওয়ানে যাত্রাবিরতি দিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় জাপানে পৌঁছালাম। বাংলাদেশ থেকে আমরা ছিলাম ৯ জন। এই প্রোগ্রামে ৩ মহাদেশের ৯টি দেশ থেকে ২৯ জন অংশ নিয়েছিল।
আমাদের রিসিভ করতে এলেন এক ভদ্রলোক। একটা ফুল দিয়ে কোস্টারে তুলে দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন ‘কন বানওয়া’। এর অর্থ হলো শুভসন্ধ্যা।
গাড়ি গিয়ে থামল টয়োটা শহরের চু বু কেনসু সেন্টারে। এখানেই হবে আমাদের প্রশিক্ষণ। আইচি প্রিফেকচারের একটি শহর হচ্ছে টয়োটা আর এই প্রিফেকচারের রাজধানী নাগোয়া।
পরদিন ছিল পরিচয় পর্ব। জাপানি প্রশিক্ষক মুরাতা আর ইয়ামাজকি জানিয়ে দিলেন, প্রথম ১০ দিন তাত্ত্বিক বিষয়ে আলোচনা হবে। আর শেষ ১০ দিন হবে জাপানের কিছু নামী কোম্পানির প্রধান কার্যালয় আর কারখানা পরিদর্শন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল টয়োটা গাড়ি প্রস্তুত কারখানা, প্যানাসনিক ইলেকট্রনিক কোম্পানি, ডানলপ টায়ার। আমাদের সমন্বয়ক ছিলেন ওডাগাওয়া সান, বেশ স্মার্ট নারী।
পরিচয় পর্বের পর ছিল একে অপরকে উপহার দেওয়া ও নেওয়ার আয়োজন। ঘানা থেকে আসা জন ও অন্য দুই নারী হিলডা ওসেই ও বোটেমা মানোউনটি সবাইকে কফির প্যাকেট দিয়েছিল। আমি সবাইকে দিলাম পাটের তৈরি ছোট ওয়ালমেট আর রুমাল, যা কিনেছিলাম আড়ং থেকে।
একদিন দুপুরে জাপানি একজনকে দেখলাম চপস্টিক দিয়ে খাচ্ছেন, তা–ও আবার মাছ। তিনি প্রথমে নিলেন নুডলস। এরপর সামান্য একটু ভাত আর মাছ। তাঁকে দেখে আমারও চপস্টিক দিয়ে খাওয়ার ইচ্ছা হলো। প্রথম প্রথম সমস্যা হলেও সত্যিই আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
একদিন ক্যানটিনে ভারতীয় বিরিয়ানি আর কাবাব রান্না হয়েছিল। আমরা আগে আগে গিয়ে তৃপ্তিসহকারে খেলাম। যাঁরা পরে গেলেন, তাঁদের ভাগে কিছুটা কম পড়ল। জাপানি খাবারে মসলা কম দেওয়া হয়। তাই ভারতীয় খাবারের অপেক্ষায় থাকতাম আমরা।
নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো তাত্ত্বিক ক্লাস।
এবার আমাদের কোম্পানি পরিদর্শনের পালা। আমাদের প্যানাসনিকের প্রধান কার্যালয় ওসাকায় যেতে হবে। বাহন ছিল জাপানের বুলেট ট্রেন। স্টেশনের এয়ারে ঘোষণা এল সিনকানসেন (বুলেট ট্রেন) আসছে। ট্রেনের ভেতরটা দেখে আমি পুরো থ। এ যেন বিমান লুক। বাংলাদেশ থেকে যারা ছিল, সবার ছিল এটা প্রথম বুলেট ট্রেনে ওঠা। সবাই ছবি তুলছে, ভিডিও করছে। ট্রেন এত গতিতে চলছে, তবে বোঝার উপায় নেই। কোনো ঝাঁকি নেই। বাইরের পাহাড়, গাছপালা, বাড়িঘর দ্রুত পেছনে হারিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে ফুরিয়ে আসছিল দিনগুলো।
রাতে লুঙ্গি পরে ঘুমাতাম। একদিন রাত ১২টায় দরজায় ঘানার জন নক করল। দরজা খুলে দেখি, জনের সঙ্গে হিলডা ও বোটেমাও এসেছে। তারা এসেছে আড্ডা দিতে। আমাকে লুঙ্গি পরা দেখে ওরা খুব আগ্রহ নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ওদের কাছে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, কোনো কিছু ছাড়া এই লুঙ্গি কীভাবে কোমরে আটকে থাকে! লুঙ্গির প্রিন্ট ওদের খুব পছন্দ হলো। আমার কাছে আবদার করল এটা তাদের উপহার দিতে হবে।
প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগের দিন ছিল বিশেষ আকর্ষণ। সবাইকে নিজ দেশের জাতীয় পোশাক পরে আসতে হবে। আমি চিন্তা করলাম, কী পরব? অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম লুঙ্গি পরেই যাব আর সঙ্গে ফতুয়া।
ওই দিন বাংলাদেশ, ব্রাজিল, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের প্রশিক্ষণার্থীরা যার যার দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এসেছিল। কিন্তু সবাই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ট্রেইনার মুরাতার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। তিনি আমাকে ডায়াসে ডাকলেন। লুঙ্গিটা কীভাবে পরতে হয়, সেটা দেখাতে বললেন। আড়াই হাত লুঙ্গি কীভাবে কোমরে আটকে থাকে, তা অনেকের কাছে ছিল বিস্ময়। তা দেখানোর পর সবাই হাততালি দিয়েছিল।
তিন সপ্তাহ শেষ। দেশে ফেরার পালা। বেশ কিছু শব্দ—‘কনিচুয়া’, ‘সুমিমাসেন’, ‘সায়োনারা’, ‘দো ইটাশিমাশিট’ এখনো মনে দাগ কেটে আছে। এই চার শব্দের অর্থ যথাক্রমে শুভ অপরাহ্ণ, দুঃখিত, বিদায়, আপনাকে স্বাগত। বেশি বন্ধুত্ব হয়েছিল ঘানার জন, হিলডা, বোটেমা, নেপালের বাহাদুর, থাইল্যান্ডের আঙ্গাকুরা থান্ডাকুলামের সঙ্গে। হিলডা ও বোটেমার সঙ্গে এত ভাব হয়েছিল যে ওদের বিয়ের কার্ড আমাকে পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ করেছিল।
আপনাদের সবাইকে ‘দোমো আরিগাদো’ (অনেক ধন্যবাদ)।
এম তারেক ইউ আহমেদ, সুগন্ধা আবাসিক এলাকা, পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম