‘দেখি জাবিরের ঊরুতে গুলি লেগেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তে শরীর ভিজে গেছে বাচ্চাটার। ওর বাবা ওকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে লাগলেন। পরে আমি ওকে কোলে তুলে নিই। ছুটে যাই হাসপাতালে। কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও বাঁচাতে পারিনি ওকে’—কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মা রোকেয়া বেগম।
গুলিতে নিহত জাবিরের মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘জাবিরের বাবার কষ্টটা বেশি। মৃত্যুর আগে জাবির তাঁর হাতেই ছিল। কিন্তু ছেলের জন্য কিছুই করতে পারলেন না।’
৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ চলাকালে মা–বাবার সঙ্গে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা জাবিরের ঊরুতে গুলি লাগে। শিশুটির পুরো নাম জাবির ইব্রাহিম। বয়স ৬ বছর। মা-বাবার সঙ্গে রাজধানীর দক্ষিণখান থানার পশ্চিম মোল্লারটেকে থাকত সে। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে পড়ত। দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে জাবির সবার ছোট। বাবা কবির হোসেন রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরে উত্তরা পূর্ব থানা-পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় উত্তরার জসীমউদ্দীন সড়কে ছিল জাবির। মা-বাবার সঙ্গে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বিজয় মিছিল দেখছিল সে। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয় ছোট্ট জাবির।
ওই দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জসীমউদ্দীন সড়কে মিছিলে ছিলেন জাবিরের চাচা নাজমুল হোসেনও। পেশায় আইনজীবী তিনি। নাজমুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত ৫ আগস্ট বিকেলে উত্তরা পূর্ব থানা ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়।
গতকাল শনিবার সকালে পশ্চিম মোল্লারটেকে জাবিরদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ফটকের সামনে বড় একটি ব্যানার ঝুলছে। তাতে লেখা আছে, ‘বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিজয় উল্লাসে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে গত ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন জাবির ইব্রাহিম, আমরা গভীরভাবে শোকাহত। সৌজন্যে: কোটা সংস্কারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কবৃন্দ।’
সেখানে কথা হলো রোকেয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাস্তায় আন্দোলনরত বাচ্চারা মারা যাচ্ছিল। মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘরে বসে সহ্য করতে পারছিলাম না। নিজেদের অপরাধী মনে হচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নিই, পরিবারের সবাই মিলে শিক্ষার্থীদের লংমার্চে অংশ নেব। ততক্ষণে জানতে পারি, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। রাস্তায় সবাই উল্লাস করছিল। আনন্দ মিছিল করছিল।’ পরে বিজয় মিছিল দেখতে যান তাঁরা।
মিছিল দেখতে জাবিরকে সঙ্গে নিতে চাননি। বাসায় দাদার কাছে ওকে রেখে যেতে চেয়েছিলেন বলে জানান রোকেয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘জেদ করে জাবির। বলে, সঙ্গে যাবেই।’ অনেকটা বাধ্য হয়ে শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরায় জসীমউদ্দীন সড়কে মিছিল দেখতে যান।
গোলাগুলি শুরু হলে মনে হচ্ছিল আতশবাজি ফোটানো হচ্ছে। তখন তিনি (জাবিরের বাবা) বাচ্চাটার হাত ধরে সামনের দিকে দৌড় দেন। আমি কিছুটা পেছনে পড়ে যাই। দৌড়াতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে যায় জাবির। তখনো জাবিরের হাত ধরে ছিল ওর বাবা। দৌড়ে এসে দেখি, রাস্তায় পড়ে আছে জাবির। ওর ঊরুতে গুলি লেগেছে। রক্তে প্যান্টসহ শরীর ভেসে যাচ্ছে।—রোকেয়া বেগম, নিহত জাবিরের মা।
রোকেয়া বেগম বললেন, ‘জাবিরের বাবা বাসায় ছিলেন। বিজয় মিছিল হচ্ছে, খবর জানিয়ে ফোনে তাঁকে জসীমউদ্দীন সড়কে আসতে বলি। এরপর জাবিরের বাবাও সেখানে আসেন। একপর্যায়ে জাবিরকে নিয়ে বাসায় ফিরে যেতে চাইলে আরও কিছুক্ষণ থাকার বায়না করে সে।’
ওই দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জসীমউদ্দীন সড়কে মিছিল দেখতে গিয়েছিলেন জাবিরের চাচা নাজমুল হোসেনও। পেশায় আইনজীবী তিনি। নাজমুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্ট বিকেলে উত্তরা পূর্ব থানা ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রোকেয়া বেগম বলেন, ‘গোলাগুলি শুরু হলে মনে হচ্ছিল আতশবাজি ফোটানো হচ্ছে। তখন তিনি (জাবিরের বাবা) বাচ্চাটার হাত ধরে সামনের দিকে দৌড় দেন। আমি কিছুটা পেছনে পড়ে যাই। দৌড়াতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে যায় জাবির। তখনো জাবিরের হাত ধরে ছিল ওর বাবা। দৌড়ে এসে দেখি, রাস্তায় পড়ে আছে জাবির। ওর ঊরুতে গুলি লেগেছে। রক্তে প্যান্টসহ শরীর ভেসে যাচ্ছে।’
রক্তাক্ত সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে দৌড়ে পাশের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয় শিশুটিকে। একই সময় গুলিতে আহত ৯৬ জন ওই হাসপাতালে এসেছেন বলে হাসপাতালে কর্মরতরা বলছিলেন। চিকিৎসক রক্ত দিতে বলেন। কিন্তু সেই হাসপাতালে রক্ত জোগাড় করা হলেও ক্রস ম্যাচের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য জাবিরকে দ্রুত উত্তরার আরেকটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে অন্য আরেকটি হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানকার চিকিৎসক জাবিরকে মৃত ঘোষণা করেন—জানালেন রোকেয়া বেগম।
এই মায়ের আক্ষেপ, প্রথমে যে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল তারা যদি সময় নষ্ট না করে বলে দিত এখানে চিকিৎসা নেই, তাহলে জাবিরকে অন্যত্র নিয়ে হয়তো বাঁচাতে পারতেন তাঁরা। তিনি বলেন, হাসপাতালে জাবিরের মৃত্যুর কারণ লেখা হয়েছে ‘ব্রট ডেড’, অর্থাৎ মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। আগের হাসপাতালটিতে জাবিরের আহত হওয়ার কারণ লেখা হয়, ‘বুলেট ইনজুরি অন থাই’।
রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আমি তো সন্তানের মা। আমি বিএনপি করি না, আওয়ামী লীগও করি না। এতগুলা বাচ্চা মারা গেল, সহমর্মিতা জানাতে রাস্তায় গিয়েছিলাম। যৌক্তিক দাবি মেনে নিলে এই পরিস্থিতি হতো না। বাচ্চারাও মারা যেত না। কেন নিরস্ত্র বাচ্চাগুলোকে মরতে হলো। প্রতিটি মুহূর্ত এ নিয়ে ভাবতে কষ্ট হয়। আমার মতো বাচ্চাদের হারিয়ে অন্য মায়েরা কত কষ্টে দিন পার করছেন, তা আমি জানি। আমি শুধু জাবির ইব্রাহিমের মা নই, প্রতিটি বাচ্চার মা। আমি একজন মা হয়ে প্রতিটি বাচ্চার হত্যার বিচার চাই।’
‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জাবির আমাকে আর ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরত। বলত, “আম্মু, এত সকালে ওঠো কেন?” কিছুদিন ধরে সকালে গুঁড়া দুধ খেত জাবির। যেদিন মারা গেল, সেদিনও খেয়েছিল। ওকে ভোলার মতো নয়। প্রতিটি সেকেন্ডে ওর স্মৃতি মনে পড়ে’—সন্তানের স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন মা রোকেয়া বেগম। সন্তান হত্যার অপরাধে আওয়ামী লীগ সরকার আর পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেও জানান তিনি।