তদন্ত প্রতিবেদন

বঙ্গবাজার পুড়েছে মশার কয়েল বা সিগারেটের আগুনে

আগুনে ভস্মিভূত হয়েছে বঙ্গবাজারের সব দোকান
ফাইল  ছবি : প্রথম আলো

রাজধানীর বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাশকতার প্রমাণ পায়নি সিটি করপোরেশেনের তদন্ত কমিটি। তারা বলেছে, মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। সিগারেটের আগুন অথবা মশার কয়েলের আগুন থেকে এই ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকার।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। ঢাকা দক্ষিণ সিটির মুখপাত্র ও জনসংযোগ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

গত ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের সাড়ে ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ততক্ষণে পুড়ে যায় বঙ্গবাজারের সব দোকান।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে মার্কেটের ছয়জন নিরাপত্তা প্রহরী ও একজন বিদ্যুৎমিস্ত্রির সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সাক্ষ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আদর্শ ইউনিটের তৃতীয় তলার আলমগীরের এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এই টেইলার্সের সরাসরি ওপরে অবস্থিত চতুর্থ তলায় আদর্শ মার্কেটের আটজন নিরাপত্তা প্রহরীর থাকার কক্ষ ছিল। আদর্শ ইউনিটের নিরাপত্তা প্রহরী বিল্লাল হোসেন (৬০) ঘটনার দিন ভোর আনুমানিক ৫টা ৪০ মিনিটে দায়িত্বরত অবস্থায় মার্কেট ও দোকানের লক সিস্টেম পরীক্ষা করতে গেলে চতুর্থ তলার নিরাপত্তা প্রহরীদের ঠিক নিচের তলায় অর্থাৎ তৃতীয় তলার আলমগীরের এমব্রয়ডারি টেইলার্সের তালা বন্ধ শাটারের নিচ থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হতে দেখেন। তিনি তখন ‘আগুন আগুন’ বলে চিৎকার করলে চতুর্থ তলা থেকে নিরাপত্তা প্রহরী দেলোয়ার ও মার্কেটের বিদ্যুৎমিস্ত্রি মামুন ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।

এরপর তাঁরা তিনজন মিলে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের চিৎকার শুনে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মার্কেটের অপর বিদ্যুৎমিস্ত্রি হাবিবুর রহমান ও অন্য প্রহরীরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং আগুন নেভানোর কাজে তাঁদের সহযোগিতা করেন। নিরাপত্তা প্রহরীরা আগুন লাগার সংবাদ ফায়ার সার্ভিসকে জানান এবং ঘটনার ১০ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে চলে আসে। তারা আগুন নেভানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। কিন্তু এর মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় ও মার্কেটের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

তদন্ত কমিটি আগুন লাগার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করেছে। প্রথমত, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে কি না; দ্বিতীয়ত, এটি নাশকতা ছিল কি না; তৃতীয়ত, দুর্ঘটনা বা অন্য কারণে ঘটেছে কি না?

কমিটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটের কাঠামোগত অবস্থান ও নির্মাণসামগ্রী বিবেচনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পর্যবেক্ষণে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সে কারণে মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে দোকানমালিক, ভাড়াটিয়া, কর্মচারী, নিরাপত্তা প্রহরীসহ সবার জন্য বৈদ্যুতিক হিটার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, যেকোনো রান্নার চুলা, মশার কয়েল ব্যবহার বা ধূমপানের বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তারপরও শাটার তালাবন্ধ অবস্থায় একটি দোকানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে। দোকানটি সরাসরি নিরাপত্তা প্রহরীদের কক্ষের নিচে অবস্থিত। সাক্ষীদের তথ্যমতে, চতুর্থ তলার নিরাপত্তা প্রহরীদের কক্ষের মেঝে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি, যাতে মাঝে মাঝে ফাঁকা বা গ্যাপ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে মেঝের ফাঁকা দিয়ে দুটি কারণে আগুন লাগতে পারে।

এর একটি হচ্ছে—ওই কক্ষে অবস্থানকারী যেকোনো প্রহরীর ধূমপানের অভ্যাস থাকলে সেখান থেকে মেঝের ফাঁকা দিয়ে তৃতীয় তলায় আগুন যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অনেক সময় ধূমপায়ীরা সিগারেট/বিড়ি মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে সিগারেটের আগুন নেভানোর চেষ্টা করে।

যেমন জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে, নিরাপত্তা প্রহরীদের একজন হোসেন পাটোয়ারীর সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল। সাক্ষ্যগ্রহণের সময় তিনি বলেন, ১৫-১৬ বছর আগে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু অন্য প্রহরীদের থেকে জানা যায়, ধূমপানের অভ্যাসের জন্য এক বছর আগেও মার্কেট কমিটি তাঁকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু এতে প্রমাণিত হয়, হোসেন তাঁর সাক্ষ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন। হোসেন তাঁর রাতের ডিউটি শেষে ইউনিফর্ম পরিবর্তনের জন্য প্রহরীদের কক্ষে যান, তারপর মসজিদে নামাজ পড়ে সেখানেই ঘুমিয়ে যান। সাহ্‌রি খাওয়ার পর যদি তিনি লুকিয়ে সিগারেট খেয়ে থাকে ও চতুর্থ তলায় পোশাক পরিবর্তনের সময় সেটি পা দিয়ে নেভাতে চেষ্টা করেন, তাহলে কাঠের তক্তার ফাঁকা অংশ দিয়ে তা সরাসরি তৃতীয় তলায় পড়ে আগুন লাগার সম্ভাবনা হতে পারে।

আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে—তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষীদের ভাষ্যমতে বঙ্গবাজার মার্কেটে মশার উপদ্রব ছিল। যার কারণে নিরাপত্তা প্রহরীরা মশার কয়েল ব্যবহার করতে পারেন এবং সেই কয়েল থেকেও তৃতীয় তলার এমব্রয়ডারি টেইলার্সে আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ২ হাজার ৯৬১টি দোকান পুড়ে ছাই হয়েছে। এ ছাড়া মহানগর মার্কেটের ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের ৫৯টি এবং বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সের ৩৪টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তদন্ত কমিটির হিসাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এসব মার্কেটের অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর মালামালের ক্ষতির পরিমাণ ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনায় ৩০৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড এড়াতে তদন্ত কমিটি ১০টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য সুপারিশগুলো হলো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন কোনো এলাকায় কাঠের/টিনের মার্কেট থাকা সমীচীন নয়। যদি থেকে থাকে, তা দ্রুত কংক্রিট বা পাকা করার ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় অবস্থিত মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা রাখা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মিত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন করে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা সচল আছে কি না, যাচাই করে সনদ দিতে হবে। সেই সনদ দৃশ্যমান স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে ওয়াটার রিজার্ভার থাকতে হবে এবং এটা থেকে পাইপের মাধ্যমে যুক্ত করে মার্কেটের চারটি স্থানে ওয়াটার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে। মার্কেটগুলোতে বিদ্যুৎ–সংযোগ, ভোল্ট ক্যাপাসিটি ও ব্যবহারের মধ্যে সামঞ্জস্য সঠিক বা পর্যাপ্ত রয়েছে কি না, তা সব সময় পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সিটি করপোরেশন অধিভুক্ত সব জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে ইত্যাদি।