নৈতিকতা ও সাহসিকতার প্রতীক হয়ে আছেন তাঁরা

দুই নাতি যারেফ আয়াত হোসেন (বাঁয়ে) ও ফারাজ আইয়াজ হোসেনের (ডানে) সঙ্গে নানা লতিফুর রহমান। রাশিয়ায়, মে ২০১৬
 ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

একজন মানুষের মৃত্যুর পর আশপাশের মানুষ সেই ব্যক্তিকে কীভাবে স্মরণ করছেন, তাঁর সম্পর্কে কী বলছেন, সেটাই সেই ব্যক্তির উত্তরাধিকার বা পরম্পরার বড় উদাহরণ। আমি নানাভাই লতিফুর রহমান ও ভাই ফারাজ আইয়াজ হোসেনকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করি। যখন একজন মানুষ থাকবেন না, তখন চারপাশের মানুষ তাঁকে কীভাবে স্মরণ করছেন—তার মধ্য দিয়েই তিনি কতটা ভালো ছিলেন, তা নিরূপিত হয়।

আমরা যদিও নানাভাই ও ছোটুকে ভীষণভাবে মিস করি, তবু তাঁরা প্রতিদিনই আমাদের মনে নৈতিকতা ও সাহসের প্রতীক হয়ে আছেন। শুধু আমরা বা পরিবারের সদস্যরা নন, চলার পথে যাঁদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়—সবাই তাঁদের দুজনকে ‘সবচেয়ে উজ্জ্বল আলো’ হিসেবে স্মরণ করেন। এটাই তাঁদের উত্তরাধিকার।

নানাভাই চলে গেছেন তিন বছর হয়ে গেছে। এই সময়টায় তাঁর নৈতিকতার উদাহরণ দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে তিনি ট্রান্সকম গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছিলেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে টিকিয়ে রাখার মতো করেই তিনি প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন।

যা–ই হোক, ব্যবসার বাইরেও তিনি সাফল্যের নজির রেখে গেছেন। তিনি একজন গর্বিত বাবা, একজন গর্বিত স্বামী এবং একজন গর্বিত নানা। তিনি যা কিছু করেছেন, মূলে ছিল ন্যায়পরায়ণতা ও সততার অবিচল চেতনাবোধ। শুধু ট্রান্সকম নয়, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকবে তাঁর রেখে যাওয়া মূল্যবোধ। উচ্চায়ত মূল্যবোধের এই বনিয়াদ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে থাকবে।

ব্যবসা ও পরিবার—উভয় পরিসরে তাঁর এই মূল্যবোধ টিকে থাকবে। তিনি যা শিখিয়ে গেছেন, তিনি যে উদাহরণ রেখে গেছেন এবং তিনি যে দর্শন রেখে গেছেন, তা পথনির্দেশক হয়ে থাকবে। তিনি যেভাবে করতে চেয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই সবকিছু চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। তিনি এভাবেই আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন এবং থাকবেন।

ফারাজের মৃত্যুর সাত বছর হলো। এখনো একজন প্রিয় সন্তান, ভাই, নাতি এবং বন্ধু হিসেবে তাকে কেউ ভোলেনি। অসীম সাহসের জন্য আজও তাকে স্মরণ করা হয়। মৃত্যুর এত বছর পরও বিশ্বজুড়ে ফারাজের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা এতটুকু কমেনি।

মাত্র ২০ বছর বয়সে ফারাজ জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু সে এমন একটি জীবন পেয়েছে, যা ওই বছরগুলোর চেয়েও অনেক মহিমান্বিত। সে এখনো অনেকের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। আজ ফারাজের মা, নানি আর ভাই হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে আমরা গর্ববোধ করি।

যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারাজের একজন সহপাঠী গতকাল (৩০ জুন) ঢাকায় এসেছেন। ১ জুলাই মৃত্যুবার্ষিকীতে ফারাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর আসা। নিজেদের শিক্ষাজীবনের অসাধারণ কিছু স্মৃতি, নোট আর ছবি তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।

যাঁরা ফারাজকে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য নৈতিক পথনির্দেশক হিসেবে অব্যাহত কাজের মাধ্যমে পরম্পরায় বেঁচে আছে সে। কী করা উচিত, বিশেষত অন্ধকারময় সময়ে সঠিক কাজ কোনটি—এ বিষয়ে সবার মধ্যে একটি নৈতিক মানদণ্ড রেখে গেছে ফারাজ। আমরা তাকে ভীষণ মিস করি। তবে একজন হাসিখুশি তরুণ হিসেবে হামলার রাতে ফারাজের আত্মত্যাগের ঘটনা আমাদের গর্বিত করে। আমরা বুঝতে পারি, ফারাজ কতটা ব্যতিক্রমী তরুণ ছিল।

আমরা যাঁরা তাকে ভালোবাসি শুধু তাঁদের মধ্যে নয়, এমনকি তার মৃত্যুর পর যাঁরা আমাদের জীবনে এসেছেন—সবার মধ্যে গভীর একটা ছাপ রেখে যেতে সক্ষম হয়েছে ফারাজ। তার সাহসী কাজের নজির এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যাঁরা ফারাজকে ভালোবাসেন এবং মৃত্যুর পর যাঁরা ফারাজকে চিনেছেন—তাঁদের সবার হৃদয়কে এক সুতোয় গেঁথে চলেছে সে।

নানাভাইয়ের মৃত্যু আমাদের জন্য বড় একটি শূন্যতা তৈরি করেছিল। ফারাজও হঠাৎ করেই খুব অল্প বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। দুজনই আমাদের হৃদয়ের কোঠরে আছেন। তাঁদের স্মৃতি কখনো আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে ব্যর্থ হয় না। এমনকি কীভাবে একটি অর্থপূর্ণ জীবন কাটাতে হয়, সেই শিক্ষাও তাঁরা আমাদের দিয়ে গেছেন।

আমাদের জীবন ব্যাখ্যাতীত নানা ঘটনায় পূর্ণ। আমি ঠিক বোঝাতে পারব না, তবে বিশ্বাস করি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের নিয়তি একই সূত্রে গাঁথা ছিল। নানাভাই ও ছোটুরমধ্যে একটি বিশেষ বন্ধন ছিল। এই বিশেষ বন্ধন তাঁরা অন্য কারও সঙ্গে নয়, কেবল নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে গেছেন। চার বছরের ব্যবধানে দুজনই ১ জুলাই—একই দিনে চলে গেছেন। সন্দেহ নেই, এখন দুজন নৈতিকতা ও সাহসের প্রতীক হয়ে একসঙ্গে ভালোবাসার মানুষদের দেখছেন।

লেখক: হেড অব স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন, ট্রান্সকম গ্রুপ।