ইউরিয়া সার কেজিতে ছয় টাকা এবং ডিজেল লিটারপ্রতি বেড়েছে ৩৪ টাকা। সার ও ডিজেলের বাড়তি দামে আমন আবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক।
ডিজেল ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ বেড়ে গেছে। খেত প্রস্তুত থেকে শুরু করে সেচ দেওয়া, মাড়াই করা, ফসল ঘরে তোলা, শ্রমিকের মজুরি—সব ক্ষেত্রেই বাড়তি খরচের বোঝা টানতে হচ্ছে।
কয়েক দিনের ব্যবধানে ইউরিয়া ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে আমনের ভরা মৌসুমে খরচ মেটাতে এখন হিমশিম খাচ্ছেন কৃষক। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অনাবৃষ্টি। এবার সারা দেশেই বৃষ্টি কম হওয়ায় আমন ধানে সেচ বেশি লাগছে। এতে উৎপাদন খরচ আরও বাড়ছে। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে খরচ উঠবে না বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। যশোর, নওগাঁ, টাঙ্গাইল ও জামালপুর—এ চার জেলায় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এমন আশঙ্কার কথা জানা গেল।
সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষি অর্থনীতিতে দুই ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের ন্যায্য দাম পেতে হবে। আবার বাজারে চালের দাম বাড়লে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের খরচ বাড়বে। চালের দাম বেড়ে গেলে গরিব মানুষের কষ্ট অবধারিতভাবে আরেক দফা বাড়বে। কারণ, দিন আনি দিন খাই মানুষের আয়ের বেশির ভাগই খাবার কিনতে খরচ করতে হয়। চাল কিনতেই বেশি খরচ হয়, যা মূল্যস্ফীতিকে আবার উসকে দেবে।
১ আগস্ট ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়িয়ে ডিলার পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ২০ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ২২ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এর চার দিন পরই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে। ডিজেল ও কেরোসিনের ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি দাম ৩৪ টাকা, পেট্রলে ৪৪ টাকা এবং অকটেনে বেড়েছে ৪৬ টাকা।
সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুক গতকাল গবেষণা সংস্থা সিপিডির এক সংলাপ অনুষ্ঠানে এ নিয়ে বলেছেন, ৬০ শতাংশ চাল আসে বোরো থেকে। এটা পুরোটাই সেচনির্ভর। ৩৭ হাজার গভীর নলকূপ, ১৩ লাখ অগভীর নলকূপ থেকে সেচ হয়। সব মিলে ১৫ লাখ কৃষি যন্ত্রপাতি আছে, যার ৭৫ শতাংশই ডিজেলচালিত। ডিজেলের দাম বাড়ায় বিঘাপ্রতি সেচের খরচ বাড়বে ৭০০ টাকা। পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর ব্যবহারে খরচ বাড়বে ৩০০ টাকা। এ ছাড়া ইউরিয়ার দাম বাড়ানোর কারণে খরচ বাড়বে ৫০০ টাকা। আবার বৃষ্টি না হওয়ায় ৩০ শতাংশ জমিতে আমন চাষ হচ্ছে না। এটিও বড় আঘাত হানতে পারে।
জুলাইয়ের শুরু থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত আমন মৌসুম। আমন ধানের চারা রোপণের সময়কাল মধ্য জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। জমি প্রস্তুত করার সময় টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সার দিতে হয়। চারা রোপণের পর জুলাই ও আগস্ট মাসে ইউরিয়ার ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। কেজিপ্রতি ৬ টাকা মূল্যবৃদ্ধির ফলে কেবল ইউরিয়া সারেই ১৫০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ) নওগাঁ জেলা শাখার সভাপতি রেজাউল ইসলাম।
আবার ভিন্নমতও আছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, ভর্তুকি মূল্যে সস্তায় কৃষকেরা রাসায়নিক সার পান। তাই তাঁরা জৈব সার ব্যবহার ভুলে গেছেন। সারে বৈচিত্র্য আনতে পারলে এই সময়ে কৃষকের হাতে সার ব্যবহারে বিকল্প থাকত। অন্যদিকে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতেও উৎপাদন খরচ বেশ বাড়ল। তাঁর মতে, চাঁদাবাজি ও পরিবহন খরচের কারণেই মূলত বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
সারে খরচ বাড়ল
ফারুক হোসেনের বাড়ি যশোরের অভয়নগর উপজেলার বগুড়াতলা গ্রামে। নিজের তিন বিঘা জমিতে এবার আমনের আবাদ করেছেন। গত বছর তিনি টিএসপি ২৮ টাকা, এমওপি ১৬ টাকা, ডিএপি ২০ টাকা এবং ইউরিয়া ১৮ টাকা কেজি দরে কিনে খেতে দিয়েছিলেন। আর ডিজেল কিনেছিলেন প্রতি লিটার ৬৫ টাকায়। গত বছর খেতে অল্প সেচ দিতে হয়েছিল। এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সেচ দিয়ে আমনের জমি প্রস্তুত করছেন।
ফারুক বলেন, ‘ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচে ও চাষে খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। গত বছর আমার সব মিলিয়ে এক বিঘা জমিতে ১৪ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছিল। এবার অবস্থা খারাপ। এক বিঘা জমিতে ২০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে।’
কৃষকের বাড়তি খরচ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ডিজেল, ইউরিয়া সার এবং কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় কৃষিতে একটা প্রভাব পড়েছে। তবে কৃষক উৎপাদিত ফসলের দামও ভালো পাচ্ছেন।
বৃষ্টি কম, সেচেও বাড়তি খরচ
বর্গা নেওয়া জমিতে ছেলে সামিউলকে নিয়ে গত মঙ্গলবার দুপুরে ধানের চারা রোপণ করছিলেন নওগাঁ পৌরসভার বোয়ালিয়া এলাকার বাসিন্দা বেলাল হোসেন। তিনি বললেন, ‘চাষাবাদ করে অ্যাখন ব্যাঁচে থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। আগে এক বিঘা জমিত একবার হাল (চাষ) দিতে পাওয়ার টিলারের মালিকেরা ২৫০ টাকা লিত। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে অ্যাখন সেটিত ল্যাওচে ৪০০ টাকা। গত বোরো মৌসুমে এই জমিত শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচ দিতে ১২০ টাকা দিতে হতো, অ্যাখন দিতে হচ্ছে ২০০ টাকা। আবার ইউরিয়া সারের দাম প্রতি ধাড়ায় (৫ কেজি) বাড়ছে ৩০ টাকা করে। অ্যাত খরচ করে ধানের ন্যায্য দাম না পাইলে বউ-ছল লিয়ে মরা ছাড়া বুদ্ধি থ্যাকবে না।’
ধান উৎপাদনে প্রসিদ্ধ নওগাঁর কৃষকেরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ধান উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে। ধানের জমি প্রস্তুতের জন্য পাওয়ার টিলার কিংবা ট্রাক্টর দিয়ে তিন চাষে আগে ৭৫০ টাকা নেওয়া হতো, এখন নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকা। অনাবৃষ্টির কারণে এ বছর সেচ দিয়ে ধান আবাদ করতেও বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। ডিজেলচালিত ইঞ্জিনে আগে প্রতি ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ টাকা নেওয়া হতো, এখন নেওয়া হচ্ছে ২০০ টাকা। এক বিঘা জমিতে একবার সেচ দিতে বাড়তি প্রায় ২০০ টাকা খরচ পড়ছে। সব মিলিয়ে এবার ধান উৎপাদনে প্রায় ৩ হাজার টাকা বেশি খরচ পড়বে।
বিঘাপ্রতি খরচ কত বাড়ছে
জামালপুরের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে এক বিঘা জমিতে রোপা আমন লাগানোর খরচের হিসাব পাওয়া গেল। কৃষকেরা খরচ বাড়ছে যেখানে, তা হলো জমিতে প্রথমে হাল ও মই বাবদ ১ হাজার ২০০ টাকা, ১০ জন শ্রমিকের ৭০০ টাকা করে মজুরি ৭ হাজার টাকা, যমুনার এক বস্তা ইউরিয়া ১ হাজার ২০০ টাকা, সেচে ডিজেল ২ হাজার টাকা, বিওপি সার ২৫ কেজি ৮০০ টাকা, এমওপি সার ৩০ কেজি ২৭০ টাকা, জিংক সালফেট সার ২৫ কেজি ২০০ টাকা, বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ১ হাজার টাকা, পানি দেওয়ার মেশিন ভাড়া ৮০০ টাকা ও সর্বশেষ মাড়াইয়ে ৭০০ টাকা। এই হিসাবে এক বিঘা জমিতে রোপা আমন চাষে কৃষকের খরচ হবে ১৫ হাজার ১৭০ টাকা। আগে বিঘাপ্রতি খরচ হতো ১১ হাজার ৬২০ টাকার মতো।
এ ছাড়া যশোরে গত বছর এক বিঘা জমিতে ১৪ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছিল। এবার এক বিঘা জমিতে ২০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে। নওগাঁয় এই খরচ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ পড়ত। এবার প্রতি বিঘায় ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ পড়বে।
শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে
ইউরিয়ার মূল্য ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে এবার টাঙ্গাইল জেলায় আমন চাষে কৃষকের লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা নেই। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার মশাজান গ্রামের কৃষক ঠান্ডু মিয়া জানান, এবার ১৫ শতাংশ জমিতে আমন ধান লাগিয়েছেন। ধানের চারা লাগাতে দুজন শ্রমিক নিয়েছিলেন। তাঁদের ৮০০ টাকা দিতে হয়েছে। ধান কাটার সময় তিনজন শ্রমিক লাগবে। কাটার ওই মৌসুমে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পায়। তখন খরচ হবে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা। ধান পাওয়া যাবে পাঁচ মণ বা তার কিছু বেশি। এর মধ্যে সেচযন্ত্রের মালিককে দিতে হবে এক মণ ধান। তাতে উৎপাদন খরচ ওঠানোই কষ্ট হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক আবদুস সাত্তার মণ্ডল এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সার ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে কৃষকের খরচ বাড়ল। এতে আমনের রোপণ বাধাগ্রস্ত হলো। ফলে চালের দাম বাড়বে। আবার ধান বা চালের দাম বাড়তেও দিতে হবে। কারণ, কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেলে আগামীবার উৎপাদন করবেন না।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, টাঙ্গাইল; প্রতিনিধি, যশোর, নওগাঁ ও জামালপুর]