গত বছর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা ও শরীরে ঘাম নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন এক তরুণ নারী চিকিৎসক (২৫)। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা যায়, তিনি হৃদ্রোগে (হার্ট অ্যাটাক) আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরে রাজধানীর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে তাঁর এনজিওগ্রাম পরীক্ষা করা হয়। তাঁর হৃৎপিণ্ডের বাঁদিকের প্রধান ধমনিতে একটি ব্লক (৮০ থেকে ৯২ শতাংশ) ধরা পড়ে। তাঁকে স্টেন্ট (হার্টের রিং) পরানো হয়। হৃদ্রোগ শনাক্ত হওয়ার বছরখানেক আগে তাঁর বুকে ধড়ফড় ও একধরনের অস্বস্তিবোধ হতো। তবে বুকে ব্যথা না থাকায় তিনি বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দেননি। তাঁর পরিবারে হৃদ্রোগের ইতিহাস আছে।
৩২ ও ৪২ বছর বয়সী আরও দুই নারীর একই হাসপাতালে একটি করে ব্লক শনাক্ত হয়। দুজনকেই স্টেন্ট পরানো হয়। দুজনেরই হৃদ্রোগের পারিবারিক ইতিহাস আছে। বুকে সামান্য অস্বস্তিবোধ ছাড়া তাঁদের খুব বেশি উপসর্গ ছিল না।
তিন নারীর সবাই ঋতুমতী। অর্থাৎ তাঁদের মাসিক চলমান। তবে প্রাকৃতিক নিয়মে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া ৫৫ বছর বয়সী অপর এক নারীর তিনটি ব্লক শনাক্ত হয়। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া এই নারীর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন) আছে।
উল্লিখিত চার নারীর প্রত্যেকেই ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট পরিচালিত একটি গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন। সম্প্রতি প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়, যেসব কারণে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগ (করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা ক্যাড) হয়, সেসব অপেক্ষাকৃত তরুণ বা ঋতুমতীদের মধ্যে উচ্চ হারে রয়েছে। ঝুঁকিগুলোর মধ্যে আছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা, বেশি ওজন, হৃদ্রোগের পারিবারিক ইতিহাস, জন্মনিরোধক বড়ি সেবন। ক্যাড হলো অন্যতম হৃদ্রোগ।
সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা বলেন, সাধারণত পুরুষের তুলনায় নারীদের হৃদ্রোগের ঝুঁকি কম। আবার হরমোনের প্রভাবে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া নারীদের তুলনায় ঋতুমতীদের ঝুঁকি আরও কম। মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া নারীদের ক্যাডের ঝুঁকি বেশি থাকার তথ্য বিভিন্ন গবেষণায় আগে উঠে এসেছে। তবে ঋতুমতীদের ক্যাডের ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা কম।
তাঁদের চিকিৎসা নেওয়ার হারও কম। এখন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা, বেশি ওজন, হৃদ্রোগের পারিবারিক ইতিহাস, জন্মনিরোধক বড়ি সেবনের মতো বিষয় ঋতুমতীদেরও হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
হৃৎপিণ্ড বা হার্ট পুরো দেহে রক্ত সঞ্চালন করে। হৃৎপিণ্ডের কোষে পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহের জন্য রক্তনালি আছে। এগুলোকে বলে করোনারি আর্টারি। চর্বি জমে বা অন্য কোনো কারণে হৃদ্যন্ত্রের এই রক্তনালি সংকুচিত হয়ে গেলে বা রক্ত চলাচলে বাধার সৃষ্টি হলে তাকে ‘ব্লক’ বলা হয়। একে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগ বা ক্যাড বলে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণাটির শিরোনাম ‘সিভিয়ারিটি অব করোনারি আর্টারি ডিজিজেস অ্যামাং প্রি অ্যান্ড পোস্টমেনোপজাল উইমেন উইথ অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোম: আ হসপিটাল-বেইজড স্টাডি ইন বাংলাদেশ’। গত ১৪ ডিসেম্বর প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিংগার নেচার গ্রুপের ওয়েবভিত্তিক ‘কিউরআস’ নামের চিকিৎসাবিজ্ঞান সাময়িকীতে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। প্রধান গবেষক ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হৃদ্রোগ বিভাগের চিকিৎসক আয়েশা সিদ্দিকা। গবেষণায় আরও যুক্ত ছিলেন হাসপাতালটির অধ্যাপক ফজিলাতুন্নেছা মালিক, সহযোগী অধ্যাপক মো. কলিমউদ্দিন, চিকিৎসক নাহিদুল হাসানসহ ১০ জন। গবেষণায় ঋতুমতী ও মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া নারীদের মধ্যে ক্যাডের বিস্তার কতটা, তার তুলনামূলক চিত্র উঠে এসেছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৪০ জন নারীর ওপর গবেষণাটি করা হয়।
এনজিওগ্রাম হওয়া এই ১৪০ জনেরই হৃদ্যন্ত্রের রক্তনালিতে ব্লক, হার্ট অ্যাটাকসহ অন্যান্য সমস্যা ছিল। তাঁদের মধ্যে ৭০ জন ছিলেন ঋতুমতী। তাঁদের গড় বয়স ছিল ৪২ বছর। বাকি ৭০ জন ছিলেন মাসিক বন্ধ হওয়া নারী। তাঁদের গড় বয়স ছিল ৫৭ বছর। সাধারণত ৫০ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে মাসিক বন্ধ হয়ে যায়।
গবেষক ও চিকিৎসক আয়েশা সিদ্দিকা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের প্রভাবে সাধারণত ঋতুমতীদের হৃদ্রোগের ঝুঁকি কম থাকে। কারণ, এই হরমোন ধমনির রক্তনালিতে চর্বি জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে রোধ করে। তবে মাসিক বন্ধ হলে এই হরমোন কমে যায় বলে ক্যাডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
তাঁদের গবেষণা অনুসারে যেসব বিষয়কে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগের জন্য ঝুঁকি মনে করা হয়, অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা, বেশি ওজন—সেগুলো ঋতুমতী নারীদের ক্ষেত্রেও উচ্চ হারে দেখা গেছে। তাঁদের বুকে খুব বেশি ব্যথা অনুভূত হয়নি। তাঁদের বুকে চাপ ও অস্বস্তি, গ্যাস্ট্রিকের ব্যথার মতো ওপরের পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি উপসর্গ ছিল।
বাংলাদেশে হৃদ্রোগ ও হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগে বছরে কত মানুষ আক্রান্ত হন, তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব নেই। তবে অসংক্রামক রোগের তথ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম এনসিডিপোর্টাল ডট ওআরজির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বছরে যত মৃত্যু হয়, তার ৩৪ শতাংশের জন্য দায়ী হৃদ্যন্ত্র ও রক্তনালির রোগ। সংখ্যার বিচারে তা ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে বিশ্বজুড়ে ১৪ কোটি ১০ লাখ পুরুষ এবং ১০ কোটি ৩১ লাখ নারী হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া নারীদের প্রায় ৮৩ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ, প্রায় ৬৯ শতাংশের ডায়াবেটিস, ৫১ শতাংশের কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা, ৩৩ শতাংশের হৃদ্রোগের পারিবারিক ইতিহাস, ২০ শতাংশের জর্দা খাওয়ার ইতিহাস, ১ শতাংশ ক্ষীণকায়, ৫০ শতাংশ স্থূলকায় এবং প্রায় ২৯ শতাংশের অতি ওজন দেখা গেছে। অপর দিকে, ঋতুমতীদের ৭৪ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ, ৪০ শতাংশের ডায়াবেটিস, প্রায় ৪৩ শতাংশের কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা, ৫০ শতাংশের হৃদ্রোগের পারিবারিক ইতিহাস, প্রায় ৩ শতাংশের জর্দা খাওয়ার ইতিহাস, প্রায় ৫৯ শতাংশ স্থূলকায় এবং প্রায় ১৬ শতাংশের অতি ওজন দেখা গেছে। এসব নারীর ৫৪ শতাংশ জন্মনিরোধক পিল সেবন করতেন।
চিকিৎসকেরা জানান, দুটি ধমনি দিয়ে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালিত হয়। বাঁদিকে লেফট মেইন করোনারি আর্টারি (এলএমসিএ) বা বাঁদিকের প্রধান ধমনি। এর দুটো ভাগ—লেফট সারকামফ্লেক্স আর্টারি (এলসিএক্স) এবং লেফট অ্যানটেরিয়র ডিসেন্ডিং আর্টারি (এলএডি)। দেহের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রক্তের সঞ্চালন হয় এলএমসিএ দিয়ে।
আরেকটি হচ্ছে রাইট করোনারি আর্টারি (আরসিএ) বা ডানদিকের ধমনি। একটি ব্লক, দুটি ব্লক ও তিনটি ব্লককে যথাক্রমে সিঙ্গেল, ডাবল ও ট্রিপল ভেসেল ডিজিজ বলা হয়। দ্রুত ব্লকের চিকিৎসা করে রক্তপ্রবাহ বাড়ানো না হলে ‘হার্ট অ্যাটাক’ হতে পারে।
গবেষণায় ঋতুমতী নারীদের ক্ষেত্রে ধমনিতে একটি ব্লক হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। আর মাসিক বন্ধ হওয়া নারীদের ক্ষেত্রে তিনটি ব্লক বেশি দেখা গেছে। ঋতুমতী নারীদের ক্ষেত্রে একটি ব্লকের হার ৩১ শতাংশ, দুটি ব্লকের হার ১৭ শতাংশ এবং তিনটি ব্লকের হার ২০ শতাংশ। অপর দিকে মাসিক বন্ধ থাকা নারীদের মধ্যে এই হার যথাক্রমে প্রায় ১৬ শতাংশ, ১৯ শতাংশ ও ৪৯ শতাংশ।
গবেষণা অনুযায়ী, দুশ্চিন্তা, হতাশা, মনের অবস্থার ঘন ঘন পরিবর্তন, ঘুমের ব্যাঘাত, বিরক্ত হওয়ার প্রবণতা, রাগ, আত্মহত্যার ভাবনা—এসব বিষয় এই রোগের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। গবেষণায় অংশ নেওয়া রোগীদের ৯৬ শতাংশের মধ্যে এসব উপসর্গ দেখা গেছে। ৭৩ শতাংশের মধ্যে অবসাদ ও ৫০ শতাংশের মধ্যে ঘুমের ব্যাঘাত লক্ষ করা গেছে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হৃদ্রোগ বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক নাহিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ঋতুমতী নারীদের ক্ষেত্রে প্রথাগত উপসর্গ কম থাকে। ফলে তাঁরা বুঝতে না পেরে দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসেন। তাই ঋতুমতীদের হৃদ্রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে, বুকের ব্যথাকে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা না ভেবে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
নাহিদুল হাসানের পরামর্শ হলো, ঋতুমতী ও মাসিক বন্ধ হওয়া—উভয় ধরনের নারীদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কমাতে হবে। কোলেস্টেরলের ভারসাম্য রাখতে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। সারা দিনের রান্নায় এক চামচের বেশি পরিমাণ লবণ খাওয়া যাবে না। খাবারে শর্করার পরিমাণ ৬৫ শতাংশ কমাতে হবে। চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না। প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটতে হবে। রান্নার পর উদ্বৃত্ত তেল দিয়ে বারবার রান্না করা যাবে না। ডালডা ও ঘি খাওয়া বাদ দিতে হবে। হৃদ্রোগ দ্রুত শনাক্ত হওয়া এবং দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।