হিন্দি চলচ্চিত্র ‘পা’–এর কথা মনে আছে? ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আর বাল্কি পরিচালিত ছবিতে অমিতাভ বচ্চন অরো নামে একটি শিশুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, যে প্রোজেরিয়ায় ভুগছে। এটি একটি জিনগত ব্যাধি, যে কারণে শিশুবেলায় বার্ধক্যের ছাপ দেখা যায় শরীরে। অমিতাভপুত্র অভিষেক বচ্চন ছিলেন সেখানে অরো (অমিতাভ) নামের সেই শিশুটির বাবার ভূমিকায়। সেখানে অরো ছিল বুদ্ধিমান ও কৌতুকপ্রিয় ১২ বছর বয়সী ছেলে। যাকে বয়সের তুলনায় পাঁচ গুণ বড় দেখায়। মায়ের সঙ্গে থাকছে, সহপাঠীদের সঙ্গে খেলছে সে।
কিন্তু প্রোজেরিয়া আক্রান্ত মিরসরাইয়ের শিশুটির (শাহদাত হোসেন) জীবনটা হিন্দি ছবির অরোর মতো অতটা বর্ণিল নয়। সবার সঙ্গে মিলেমিশে পড়ালেখা ও খেলাধুলা করার বয়স তার। কিন্তু তা পারছে কোথায়!
৯ পেরোনো শিশুটির (শাহদাতের) মধ্যে যে এখনই বার্ধক্য ভর করেছে। এখন নয়, বলতে গেলে সাত মাস বয়স থেকেই বার্ধক্যের ছাপ পড়তে শুরু করে তার শরীরে। বিরল প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত শিশুটির অবয়ব সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধের মতো। সে কারণে সমবয়সী শিশুরা তাকে এড়িয়ে চলছে। এড়িয়ে চলছে বড়রাও।
রিকশাচালক মো. হানিফ ও নাছিমা আকতারের একমাত্র ছেলে শাহদাত। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে শাহদাত সবার ছোট। নিজের ভিটা নেই হানিফের। তাই পরিবার নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি জায়গায় ছোট্ট টিনের একচালা ঘর করে বসবাস করেন। জীবনযুদ্ধে যেখানে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে তাঁর ঘরে বাসা বেঁধেছে এমন একটি রোগ।
শাহদাত সবে ১০ বছরে পা দিয়েছে। এখনই তার গায়ের চামড়া মুখমণ্ডল সত্তর বছরের বৃদ্ধকে ছাড়িয়ে গেছে। সাড়ে তিন ফুট উচ্চতার শাহদাতের মাথার চুল বড়দের মতো পড়ে যাচ্ছে। দাঁত নড়বড়ে হয়ে গেছে। হাত–পায়ের শিরা ফুলে উঠেছে চামড়ার ওপর। চোয়াল, কপাল ও কান ঝুলে পড়েছে। বুক ধড়ফড় করে। রাতে ঘুমাতে পারে না। এ সবকিছুই ওই বিরল প্রেজরিয়া রোগের কারণে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
শিশুটির জন্ম ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে, সিজারিয়ানের মাধ্যমে। দুই মেয়ের পর একটি ছেলে পেয়ে খুশিই হয়েছিলেন হানিফ-নাছিমা। কিন্তু তাঁদের সেই খুশি মিলিয়ে যেতে এক বছরও লাগেনি। সাত মাস বয়সেই তার মধ্যে পরিবর্তন ধরা পড়ে। তাকে নিয়ে আবার চমেক হাসপাতালের শরণাপন্ন হয়েছিল এই দম্পতি।
সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করলেন রিকশাচালক বাবা, ‘সাত মাস যেতেই আমার ছেলের চামড়া কুঁচকে যেতে শুরু করে। আমরা তখন নিরুপায় হয়ে মেডিকেলে যাই। সেখানে ১ মাস ১৩ দিন চিকিৎসা করানো হয়। অনেক চিকিৎসক দেখেছেন। বাইরের দেশের চিকিৎসকও। পরে তাঁরা জানালেন প্রেজেরিয়ায় আক্রান্ত আমার ছেলে। মানে আগেভাগে বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। এর চিকিৎসা এখানে নেই। আমেরিকায় এই রোগের চিকিৎসা রয়েছে।’
চিকিৎসকেরা জানান, প্রোজেরিয়া রোগে আক্রান্ত শিশু ৭ থেকে ২০ বছরের বেশি বাঁচে না। দেশে এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। চমেক হাসপাতালে শাহদাতের চিকিৎসা বিষয়ে এখন কোনো রেকর্ড সেভাবে নেই। তবে হাসপাতালের অবসরে যাওয়া দুই চিকিৎসক বিষয়টি মনে করতে পেরেছেন।
চমেক শিশু সার্জারি বিভাগ থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে অবসরে যান বিভাগীয় প্রধান তামমিনা বানু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৫ সালের দিকে একটা শিশু আমরা পেয়েছিলাম। শিশুটির বয়স তখন এক বছরের কম ছিল। প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত ছিল সে। তবে সেটা এই বাচ্চা (শাহদাত) কি না, মনে নেই। প্রোজেরিয়া হচ্ছে প্রি–ম্যাচিউইর বয়সী রোগ। অর্থাৎ তার মধ্যে বয়সের ছাপ থাকবে কম বয়সেই। তার কিডনি, হার্ট, ব্রেন সবকিছু বয়োবৃদ্ধ হবে। এ কারণে তারা বেশি দিন বাঁচে না।’
শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক লেখক প্রণব কুমার চৌধুরীও এমন একটি শিশুর চিকিৎসা নেওয়ার কথা স্মরণ করতে পেরেছেন। চমেক হাসপাতালেই রোগটি নির্ণয় করা হয়েছিল বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে প্রণব কুমার চৌধুরীর প্রবন্ধও রয়েছে।
প্রবন্ধে প্রণব চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, প্রেজেরিয়া একটা আনক্লাসিফায়েড ডিজিজ বা শ্রেণিহীন রোগ। একে প্রিম্যাচিউর সিনাইলিটি বা অকালে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া বলে। আট মিলিয়ন শিশুর মধ্যে একজন শিশু এভাবে জন্মাতে পারে। মূলত জিনগত প্রভাব থেকে হয় এটা। বেশি বয়সী বাবার ক্ষেত্রে শিশু এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এ ছাড়া জিনের মিউটেশনের মাধ্যমে হঠাৎ করেও আসতে পারে এটা।
প্রণব কুমার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শিশুর উচ্চতা অনুপাতে ওজন কম হয়। উচ্চতাও কম হয়। বৃদ্ধিতে পিছিয়ে থাকে। শরীরে চর্বি থাকে না। মুখ বুড়ো মানুষের মতো, চোখের ভ্রু থাকে না। তাদের হার্টের রক্ত সঞ্চালন কম থাকে। হার্ট অ্যাটাক হয়। কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজে আক্রান্ত হয়। হাত-পায়ের জয়েন্ট শক্ত থাকে। এই রোগের এত দিন কোনো চিকিৎসা সেভাবে ছিল না। সম্প্রতি একটা ওষুধ বের হয়েছে। এ ছাড়া ফিজিওথেরাপি রয়েছে। এতে করে আয়ু কিছুটা বাড়ছে। এটাকে হাটসিনস-বিলফোর্ড ডিজিজও বলা হয়।
হিন্দি ‘পা’ ছবিতে প্রেজেরিয়া আক্রান্ত অরো থাকে তার মা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বিদ্যা বালানের সঙ্গে। অরোকে নিয়ে তার তেমন কোনো দুঃখ ছিল না। কিন্তু মিরসরাইয়ের শিশুটিকে নিয়ে তার মা–বাবার দুঃখের দিন বাড়ছে কেবল।
শাহদাত এখন মিরসরাইয়ের বাড়িতে থাকে। তার গলার স্বর এখনো শিশুর মতো। কিন্তু কোনো শিশু তার সঙ্গে খেলে না। সে স্কুলে যায়, পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। সেখানে তার তেমন কোনো বন্ধু নেই। সহপাঠীরা তাকে এড়িয়ে চলে। শুধু ছোটরা কেন, বড়রাও তাকে অবহেলা করেছে বলে অভিযোগ মা–বাবার।
মা নাছিমা আকতারের অভিযোগ, ছেলেকে তাঁদের বাড়ির পাশের একটি স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ভর্তি নেননি। প্রধান শিক্ষিকার যুক্তি ছিল, তাকে দেখলে অন্য সব শিশু ভয় পাবে। একটি মাদ্রাসায়ও তাকে ভর্তি করাতে রাজি হয়নি। শেষমেশ তাদের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়।
বাবার কিনে দেওয়া একটি সাইকেলই এখন শিশুটির সঙ্গী। সেটি চালায় মাঝেমধ্যে। তবে খুব দুর্বল থাকে সে। রাতে ঘুমাতে পারে না। যন্ত্রণায় ছটফট করে। শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে যায়। ঘুম হয় না। ঠিকমতো খেতে পারে না। তার খাওয়া বলতে ফলমূল। বাবা বলেন, ‘গরিব মানুষ। কীভাবে ফলমূল খাওয়াব। নিজেরাই থাকি একটা সরকারি জায়গায় ঘর বেঁধে।’ ছেলের চিকিৎসা–সহায়তায় যেন রাষ্ট্র এগিয়ে আসে, এমন আশা এই রিকশাচালক বাবার।
‘পা’ চলচ্চিত্রে অরোর বাবা অমল আর্তে (অভিষেক বচ্চন) একজন তরুণ ও উজ্জ্বল রাজনীতিবিদ। তাঁর সঙ্গে মা বিদ্যার সম্পর্ক ছিল না। অরো যে তাঁর ছেলে, সেটা অমলও জানতেন না। ১৩তম জন্মদিনে অরোর শারীরিক ত্রুটিগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মা-বাবাকে আবার এক করে দেয়। বিদ্যাকে ‘মা’এবং অমলকে ‘পা’ সম্বোধন করে অরো মারা যায়।
আর চট্টগ্রামের শাহদাতকে নিয়ে মা-বাবার জীবনযুদ্ধের শেষ কোথায়, তাঁরা নিজেরাও জানেন না।