বাংলা চ্যানেল ৯ বার

২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো এ বছরের বাংলা চ্যানেল সাঁতার। বঙ্গোপাসাগরে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমুদ্রপথ বাংলা চ্যানেল নামে পরিচিত। আয়রনম্যান মোহাম্মাদ সামছুজ্জমান আরাফাত এ নিয়ে নবমবারের মতো জয় করলেন বাংলা চ্যানেল। তিনি লিখছেন এবারের সাঁতার তাঁর অভিজ্ঞতা।

সাঁতার কাটছেন মোহাম্মাদ সামছুজ্জমান আরাফাত
ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গোপসাগরের বাংলা চ্যানেলে এবার আমার নবমবারের মতো অংশগ্রহণ ছিল। তাই বলে চিন্তা বা উদ্বেগ কোনো অংশে কম ছিল না। কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন, বঙ্গোপসাগরে ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটারের সমুদ্রপথ এই চ্যানেল। এটি আমার কাছে দেশের কঠিনতম অ্যাডভেঞ্চার।

প্রতিবার অংশগ্রহণ নিয়ে কত জল্পনাকল্পনা থাকে। এবারও ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য এবার অনুশীলন করতে আগে সেন্ট মার্টিন পৌঁছাতে পারিনি। আগে প্রতিবছর দুই-তিন দিন অনুশীলন করতাম। এবার আগের রাতে (২১ ডিসেম্বর) টেকনাফ পৌঁছানোর কারণে সুযোগটা হলো না।

সেই রাতে ৩১ জন সাঁতারুর মধ্যে ২৪-২৫ জন টেকনাফে অবস্থান করায় সবার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। আমরা ছিলাম টেকনাফ শহরে সি কোরাল হোটেলে। রাতে আমাদের ‘সি হর্স’ সাইফুর ইসলামের নেতৃত্বে আমরা সবাই যার যার অভিজ্ঞতা বিনিময় করি। খুব ভালো কেটেছিল সময়টা।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর ঘুম আসছিল না। সাঁতার নিয়ে কত রকম উদ্ভট চিন্তা। শেষরাতের দিকে একটু ঘুম আসছিল, তা আবার অ্যালার্মে ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে খুব দ্রুত শাহপরীর দ্বীপে রওনা হয়ে যাওয়ার আগে সায়েমকে ফোন দিলাম সেন্ট মার্টিন থেকে পুরো দলের খবর জানতে। জানতে পারলাম, সবাই রওনা করেছে।

মোহাম্মাদ সামছুজ্জমান আরাফাত

আমরা এবং সেন্ট মার্টিন থেকে আসা সবাই প্রায় একই সময়ে পৌঁছালাম শাহপরীর দ্বীপে। সাঁতারু মনির ভাই ও সায়েমের সঙ্গে কিছু খুনসুটি করে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম। প্রস্তুতি শেষে আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি। সকাল নয়টা সাত মিনিটে আমাদের সাঁতার শুরু। সাঁতার শুরু করতেই অনেক বড় বড় ঢেউ। একটা ঢেউ তো এত জোরে আসে, আমার গগলসটা (সাঁতারের চশমা) খুলে গেল, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কিছুক্ষণ সাঁতার কাটতে লাগলাম।  

এক স্ট্রোক দুই স্ট্রোক করে সমুদ্রের দিকে যেতে যেতে আমার উদ্ধারকারী নৌকাটা খুঁজে পাই। আমার এবারের উদ্ধারকারী ছিলেন সাব্বির। আগে কখনো দেখা হয়নি তাঁর সঙ্গে। কিন্তু তাঁর ইশারা দেখে একটুও মনে হয়নি আমাদের আগে কখনো দেখা হয়নি। দেখেই খুব আপন মনে হলো। কারণ, মানুষটি পুরো সমুদ্রপথে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের উদ্ধার অভিযানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আছেন। তিনিসহ সব স্বেচ্ছাসেবক ভাইয়ের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।

হাতঘড়িতে আমার সাঁতারটা পুরো ট্র্যাক করা শুরু করেছিলাম। প্রতি ৫০০ মিটার পরপর আপডেট আশা শুরু হলো। প্রথম ৫০০ মিটার যেতে ১০ মিনিট পরের ৫০০ মিটার যেতে ১১ মিনিট, এর পরের ৫০০ মিটার যেতে আরও ১১ মিনিট দেখে আমি চিন্তায় পড়লাম। কারণ, পুকুরের পানিতে স্বাভাবিকভাবে সাড়ে ৯ মিনিটে ৫০০ মিটার সাঁতার হয়ে যায়। কিন্তু সমুদ্রের সাঁতারটা ভাটার একটু টান থাকায় আরও দ্রুত হওয়ার কথা। পরপর এ রকম আপডেট পেয়ে আমি ভেবে নিলাম, আজ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা হতে চলছে।

শুরু থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ সালাহ আর আমি একসঙ্গে সাঁতার কেটে আসছিলাম। দুজন একই সঙ্গে সাঁতার কাটতে থাকলাম। গত বছরও আমরা একসঙ্গে সাঁতার কেটেছিলাম। পাঁচ কিলোমিটার পর মনির ভাইকে পেলাম। শুরু হলো তিনজনের একসঙ্গে সাঁতার কাটা।

কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়া সমুদ্রসৈকত থেকে আজ সকালে সাঁতার শুরু হয়

প্রতি ৫০০ মিটার পরপর আপডেট আসতে লাগল। তিন কিলোমিটারের পর ধীরে ধীরে গতি একটু বাড়ল। কিন্তু ৫০০ মিটার দূরত্বে পেরোতে সাড়ে ৮ মিনিট সময়ের মধ্যেই আটকে থাকলাম। বুঝতে পারছিলাম আজ সমুদ্রে ভাটার টান নেই। এটা ধীরগতির সাঁতার হতে চলেছে। পানি খুব ঠান্ডা লাগছিল। প্রায় আড়াই ঘণ্টায় আট কিলোমটার পথ শেষ করার পর মনে হচ্ছিল আজ পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে।

ধীরে ধীরে সাঁতার কাটতে লাগলাম। হঠাৎ মনির ভাই বলে উঠলেন, আমরা তো এসে পড়েছি! ওই যে দ্বীপ। তখন তিন ঘণ্টা হয়েছে মাত্র। দ্বীপ দেখার চেষ্টা আমি করছিলাম না। বলার পর উৎসুক হয়ে আমি দ্বীপ দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম আর মনে হচ্ছিল ‘বাহ্ চলেই তো এলাম।’ তখন শীতের কাঁপুনি শুরু হলো।

আমি ভেবে নিলাম এই তো শেষ, শীতকে এত পাত্তা দেওয়া যাবে না। আস্তে আস্তে কাঁপুনি বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছিল, হাত দুটো আর চলছে না। স্ট্রোকের পর স্ট্রোক দিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু আমি আর আগাই না। খুব কষ্ট হচ্ছিল। শীতে আমি অনেক দুর্বল হয়ে যাই। তখন তেহজীব ভাইয়ের (স্বেচ্ছাসেবক) আট বছর আগের একটা কথা মনে পড়ল। বলেছিলেন, ‘শরীরে চর্বি না নিয়া সাঁতার কাটতে আসছে ঠান্ডায়। কী বোকা।’ ওই দিন ভেবেছিলাম, শরীরে চর্বি না থাকলেও মনে চর্বি আছে। কিন্তু আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম ঠান্ডা। খুব কাঁপছিলাম।

এর মধ্যে এক স্ট্রোক দুই স্ট্রোক করে এগোনোর চেষ্টা করালম। হঠাৎ সালাহ বলে উঠল, ‘ভাই দাঁড়িয়ে যান।’ কী পরম শান্তি পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাওয়া । কোনোমতে আমি আর সালাহ হেঁটে হেঁটে একসঙ্গে রিপোর্ট করতে গেলাম। ৪ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট ৭ সেকেন্ডের ‘যুদ্ধ’ শেষ। শীতের কাঁপুনিতে না দাঁড়াতে পেরে গরম পানির সন্ধানে চলে যাই। গোসল করার কিছুক্ষণ পর মনে হলো, আমি আবার বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পার করলাম। আবারও ভিন্ন রকম। ভিন্ন রকম ঢেউ। অদ্ভুত এক অনুভূতি।

সাগরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। সাগরের বিশালতার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার এক বন্ধুত্ব। আর এ বন্ধুত্ব আমাকে একজন সেরা মানুষ হওয়ার জন্য পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে যায় প্রতিনিয়ত। বাংলা চ্যানেল বেঁচে থেক শতাব্দীর পর শতাব্দী।  সুযোগ দিয়ো তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার! ভালো থেকো প্রিয় বাংলা চ্যানেল। বেঁচে থাকলে দেখা হবে দশম বার।