সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২ হাজার ১১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আজ রোববার বেলা ১১টায় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে এ অভিযোগ করা হয়।
স্মারকলিপিটি দিয়েছেন আবদুল জব্বার জলিল কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি আবদুল জব্বার জলিল। সিলেটের এই ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশ (আটাব) সিলেটের সাবেক সভাপতি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কাজ করে আসছেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, বিগত সরকারের আমলে ২ হাজার ১১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ওসমানী বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ও দেশি-বিদেশি ফ্লাইট চালুর জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট কাজ শুরু হয়ে ২০২৩ সালের ২৭ মের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে আরও এক বছর সময় চলে গেলেও মাত্র ২২ শতাংশ কাজ হয়েছে।
প্রকল্পের ২০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পর এটি ‘ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন’-এর মানদণ্ডে হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে ধরা পড়ে বলে স্মারকলিপিতে অভিযোগ করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, প্রকল্পের টাকা লোপাটের উদ্দেশ্যেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জ্ঞাতসারে নকশায় ত্রুটি রেখেছিলেন। ফলে শুরুতেই প্রকল্পের কাজ থমকে যায়। এতে প্রকল্পে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী অযত্ন–অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। মেয়াদ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে অর্থ আত্মসাতের জন্যই প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্র ও ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করে আবদুল জব্বার জলিলের কাছে প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র ধরা পড়েছে বলে স্মারকলিপিতে জানিয়েছেন। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা এসব অনিয়মের মধ্যে প্রথমটি হলো ‘প্রকল্প শুরুর আগেই ইকুইপমেন্ট মোবিলাইজেশন বাবদ অগ্রিম ২১২ কোটি টাকা নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি)। প্রকল্প–সংশ্লিষ্টরা ২২ শতাংশ কাজ হয়েছে বললেও অভিযোগকারীর ধারণা, এখনো প্রতিষ্ঠানটি ১০০ কোটি টাকার বেশি কাজ করেনি।’ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনো অগ্রিম নেওয়া টাকা ব্যয়ের হিসাব দেয়নি বলে স্মারকলিপিতে আবদুল জব্বার দাবি করেন।
প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে দুজন পরিচালক নিয়োগ দিলেও বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার জন্য তাঁরা প্রকল্প থেকে সরে যেতে বাধ্য হন বলে স্মারকলিপিতে বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, ‘ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নকশায় ত্রুটি রেখে প্রকল্পের কাজ শুরুর একমাত্র কারণ ছিল প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে অর্থ আত্মসাৎ। এর প্রমাণও মিলেছে। প্রকল্পের ৩০ শতাংশ কাজ বাদ দিয়ে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২ হাজার ১১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় এখন ২ হাজার ৯১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দিতে প্রকল্পের মূল নকশা থেকে তিনটি বোর্ডিং ব্রিজ, কার্গো বিল্ডিং অ্যান্ড পার্কিং এরিয়া, কার্গো অ্যানেক্স বিল্ডিং, ফায়ার ফাইটিং স্টেশন বাদ দেওয়া হয়েছে বলেও স্মারকলিপিতে অভিযোগ করা হয়। এসব অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করে ওসমানী বিমানবন্দর থেকে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট চালুর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।
স্মারকলিপিতে আবদুল জব্বার জলিল বলেন, প্রবাসী-অধ্যুষিত সিলেটের অন্তত ২৫ লাখ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত প্রবাসীদের সিংহভাগই সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দা। মাতৃভূমি ও পরিবার-পরিজনের টানে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে আসেন। তাই সিলেটের প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাতে বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোও ওসমানী বিমানবন্দর থেকে অপারেট করার দাবি জানিয়ে আসছে।
অতীতে বিভিন্ন সময় ওসমানী বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ফ্লাইট চলাচল বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও সিভিল এভিয়েশনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঢাকার কিছুসংখ্যক দুর্নীতিবাজ ট্রাভেলস এজেন্সির মালিক ও হোটেল মালিক মিলে গঠিত সিন্ডিকেট সেই উদ্যোগ সফল হতে দেয়নি বলে আবদুল জব্বার জলিল স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন। তিনি লিখিতভাবে স্মারকলিপিতে বলেছেন, ‘সিলেট থেকে বিদেশি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট চালু হলে সিলেটের প্রবাসীরা সরাসরি সিলেট থেকে যাতায়াত করতে পারবেন। এতে ঢাকার ট্রাভেল এজেন্সি ও হোটেল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে অর্থ লুটপাটের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।’
জানতে চাইলে বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক মইদুর রহমান মো. মওদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পের ড্রয়িং-ডিজাইন ২০১৮’ সালে করা হয়েছিল। তবে কাজ শুরুর পর ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন ও বাংলাদেশ জাতীয় ভবন নির্মাণ বিধিমালার নতুন হালনাগাদ নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যানসহ আনুষঙ্গিক নকশা হালনাগাদ করা হয়। তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমেই হালনাগাদ করার জন্য নকশাকার নিয়োগ করা হয়। কাউকে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো কাজ হয়েছে, এমনটা ঘটেনি। এখন দ্রুত যেন উন্নয়নকাজ শেষ হয়, সেই প্রচেষ্টা চলছে।’ এ ছাড়া নকশা থেকে কোনো কিছু বাদ দেওয়ার বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে তিনি জানান।