পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলেন, কয়েক দিন ধরে বিবিয়ানা ও তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণ চলছে। এতে উৎপাদন কিছুটা কমে গেছে।
আজ রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বন্ধ থাকবে একটি এলএনজি টার্মিনাল। এতে গ্যাসের সরবরাহ আরও কমে যাবে।
গ্যাস সরবরাহে সব সময়ই ঘাটতি থাকে। দেশে উৎপাদন কমে আসায় এ ঘাটতি আরও বাড়ছে। আমদানি করেও চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু করায় সরবরাহ আরও কমে গেছে। এতে গ্যাসের সংকটে ভুগছেন শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকেরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গ্যাস–সংকট কাটছেই না। আগামী বছর এটি আরও বাড়তে পারে।
দেশে দিনে এখন গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। দিনে সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামলানো হয়। প্রতিনিয়ত এক খাতে কমিয়ে আরেক খাতে বাড়াতে হয়। এর চেয়ে সরবরাহ কমে গেলেই চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৮৪ কোটি ঘনফুট। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ১৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো।
দিনে চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট, সর্বোচ্চ সরবরাহ হয় ৩০০ কোটি। এখন হচ্ছে ২৮০ থেকে ২৮৪ কোটি ঘনফুট।
দেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র। আর মজুতের দিক থেকে সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র হলো তিতাস। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলেন, কয়েক দিন ধরে দুটি গ্যাসক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণ চলছে। এতে উৎপাদন কিছুটা কমে গেছে। আজ সোমবার রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বন্ধ থাকবে একটি এলএনজি টার্মিনাল। এতে গ্যাসের সরবরাহ আরও কমে যাবে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, বিদ্যুৎ খাতে চাহিদা কম থাকায় সার কারখানায় সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। শীতে চাহিদা কম থাকায় এ সময়টা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেছে নেওয়া হয়। এতে সরবরাহ কিছুটা কমেছে। মঙ্গল-বুধবার থেকে সরবরাহ আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করবে।
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রান্নার চুলা জ্বালাতে পারছেন না গ্রাহক। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত বিসিক শিল্পনগরীর একটি কারখানার শ্রমিক নুরুন্নাহার বলেন, তাঁর এলাকায় গ্যাস সরবরাহ থাকে না বললেই চলে। প্রতিদিন রাতে পরিবারের চার সদস্যের জন্য মাটির চুলায় রান্না করেন। সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি দক্ষিণপাড়া এলাকার বাসিন্দা আসমা বেগম বলেন, গ্যাস না পেলেও প্রতি মাসে বিল দিতে হচ্ছে। এরপর মাসে অন্তত দুই হাজার টাকা এলপিজি সিলিন্ডারে খরচ হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার টানবাজার সাহাপাড়া, বাবুরাইল, পাইকপাড়া, তামাকপট্টি, নলুয়া, ভূঁইয়াপাড়া, নয়াপাড়া, জল্লারপাড়, দেওভোগ, মণ্ডলপাড়া, কালিরবাজার, কাশিপুর, জামতলা, মাসদাইর, আমলাপাড়া, খানপুর, তল্লা, ফতুল্লার ধর্মগঞ্জ, পঞ্চবটি, মুসলিম নগর, সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি, কদমতলী, বন্দরের আমিন, র্যালি ব্রাদার্সসহ রূপগঞ্জ আড়াইহাজার ও সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় গ্যাসের সংকট চলছে। কোনো কোনো দিন চুলাই জ্বলছে না এসব এলাকায়।
বিসিক শিল্পনগরী, সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী ইপিজেড, ফতুল্লা, রূপসী, কর্ণগোপ, কাঁচপুর শিল্পাঞ্চলগুলোর শিল্পকারখানাগুলোতেও গ্যাসের সংকট চলছে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা, স্পিনিং, টেক্সটাইল, রি-রোলিং মিলসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফতুল্লার ফারিহা নিট টেক্স লিমিটেডের জিএম (ওয়াশ) শাহ জামাল আলী প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে দুই থেকে আড়াই গুণ।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মো. হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত এক মাসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। ডিজেল, ফার্নেস তেলের পাশাপাশি লাকড়ি ও ঝুট বয়লার ব্যবহার করছি। নিট পোশাক খাতে যতগুলো সংকট আছে, এর মধ্যে প্রধান সংকট হলো গ্যাস।’
গাজীপুরে গ্যাস–সংকটে ভুগছে পোশাকশিল্প কারখানা। গ্যাসের চাপ কম থাকায় অধিকাংশ কারখানায় সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। আবাসিকে সমস্যা আরও বেশি। মহানগরের কোনাবাড়ী পারিজাত এলাকার বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস সমস্যায় ভুগছেন। মাঝে কিছুদিন গ্যাস পাওয়া গিয়েছিল, তবে এখন শীত আসায় আবার একই সমস্যা।
গতকাল রোববার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ ধরে গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া, বাসন সড়ক, কড্ডা, কোনাবাড়ী, কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর, মৌচাক, পল্লী বিদ্যুৎ, কালিয়াকৈর বাজার, সাহেব বাজারসহ ২৫-২৬টি অঞ্চলে গ্যাস–সংকট রয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কালিয়াকৈর উপজেলার খাড়াজোড়া এলাকার সামছুল আলামিন স্পিনিং মিলস নামের একটি সুতার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ৪০টি মেশিনের সব কটিই বন্ধ। শ্রমিকেরা বসে আছেন। তাঁরা জানান, সকালে কয়েকটি মেশিন চালু করা হলেও দুপুরের পর আর চলে না। গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী এলাকার যমুনা কারখানার প্রকৌশলী মো. এরশাদ হোসেন বলেন, কারখানার গ্যাসের চাপ খুব কম থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন টানা কমছে। আগামী পাঁচ বছর এখানে উৎপাদন ধরে রাখা কঠিন হবে, ধারাবাহিক হারে উৎপাদন কমতে থাকবে। গ্যাস–সংকট থেকে উত্তরণের একটাই উপায়, দেশের গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ