সার, বীজ ও জ্বালানি তেলের দাম এবং মজুরি বেড়েছে।
চাল উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে কেজিতে ৩ টাকা।
দরিদ্ররা আয়ের ২৯-৩২% ব্যয় করেন চাল কিনতে।
বোরো মৌসুমে এবার চালের উৎপাদন বেশ ভালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে উৎপাদন বাড়লেও দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমার আশা কম।
দেশে বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদিত হয়। এবার বোরো মৌসুম তেমন কোনো দুর্যোগের মুখে পড়েনি। ইতিমধ্যে হাওরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলেও ধান পাকতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও কাটা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) ৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দানাদার খাদ্যবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলেছে, এবারের বোরো মৌসুমে বাংলাদেশে চাষের আওতা ৫০ হাজার হেক্টর বেড়ে ৪৯ লাখ হেক্টর হয়েছে বলে তাদের ধারণা। আর চাল উৎপাদন ৫ লাখ টন বেড়ে ২ কোটি ৫ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে।
বোরো মৌসুমে বড় কোনো দুর্যোগ হয়নি। শুরু হয়েছে ধান কাটা। মৌসুম শুরুর আগে এক মাসে দাম ২-৫% বেড়েছে।
দাম উল্লেখযোগ্য হারে না কমার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় সামনে আনা হচ্ছে: এক. চালের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। দুই. বিশ্ববাজারে চালের দাম বেশি এবং বাংলাদেশের জন্য সাশ্রয়ী উৎস ভারতের চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা। চার. বাংলাদেশে মার্কিন ডলারের সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, যা চাল আমদানিকে ব্যয়বহুল করেছে।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়, চালের দাম এখনকার পর্যায় থেকে কমার সম্ভাবনা নেই।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, চালের দাম কমে গিয়ে উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ কমে যাক, সেটা সরকারও চায় না। এ কারণে চালের দাম বর্তমান অবস্থার কাছাকাছি থাকুক বলে তারা চায়।
চাপ প্রয়োগ করে ও দাম বেঁধে দিয়ে চাল ও অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম কমানো যাবে না। বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে।মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগ
জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোরো ধান ওঠা শুরু করেছে। চালের দাম এত দিন যা ছিল, তার চেয়ে কমবে বলে আশা করি। তবে কৃষক যাতে ভালো দাম পান, দাম যাতে বেশি না কমে যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, উৎপাদন খরচও বেড়েছে, তা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।’
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকাল শনিবারের হিসাবে, ঢাকার বাজারে এখন এক কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। মাঝারি চাল ৫৫ থেকে ৫৮ এবং সরু চাল জাতভেদে ৬৫ থেকে ৭৬ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগের তুলনায় চালের দাম ২ থেকে ৫ শতাংশ বেড়েছে।
দেশে ২০২০ সাল থেকেই চালের দাম বাড়তি। ওই বছরের শুরুতে মোটা চালের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এরপর বিভিন্ন সময় চাল আমদানি হয়েছে, আমদানির জন্য শুল্ক-কর কমানো হয়েছে, বাজারে অভিযান হয়েছে, দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে—কোনো কিছুই দাম কমাতে পারেনি।
বোরো ধান ওঠা শুরু করেছে। চালের দাম এত দিন যা ছিল, তার চেয়ে কমবে বলে আশা করি। তবে কৃষক যাতে ভালো দাম পান, দাম যাতে বেশি না কমে যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, উৎপাদন খরচও বেড়েছে, তা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।’মো. ইসমাইল হোসেন, খাদ্যসচিব
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে চালের সরকারি মজুত ছিল ৮ লাখ ৭৭ হাজার টনের বেশি। দেশে ধান আবাদের মৌসুম তিনটি—বোরো, আমন ও আউশ। বোরো মৌসুমে প্রায় ২ কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়, যা মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি।
ইউএসডিএর পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২৪-২৫ বিপণন বর্ষে তিন মৌসুম মিলিয়ে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টন চাল উৎপাদিত হতে পারে, যা আগের বিপণন বর্ষের চেয়ে ৭ লাখ টন বেশি।
অবশ্য উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে। ইউএসডিএর হিসাবে, ২০২৪-২৫ বিপণন বর্ষে চালের ভোগ দাঁড়াতে পারে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১ শতাংশ বেশি। পোলট্রি, মাছ, পশুখাদ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাঙা চালের ব্যবহার বাড়ছে। কারণ, আমদানি করা উপকরণের চেয়ে ভাঙা চালের দাম কম। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের এক সমীক্ষার বরাত দিয়ে ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে প্রায় ৩৫ লাখ টন ভাঙা চাল প্রাণিখাদ্যের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২৪-২৫ বিপণন বর্ষে তিন মৌসুম মিলিয়ে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টন চাল উৎপাদিত হতে পারে, যা আগের বিপণন বর্ষের চেয়ে ৭ লাখ টন বেশি।
চাল বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। চালের পর খাদ্যশস্য হিসেবে গমের চাহিদা বেশি, প্রায় ৭০ লাখ টন। তবে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও ডলার-সংকটের কারণে গম আমদানি তুলনামূলক কম হচ্ছে। এতে চালের চাহিদা বেড়েছে বলেও বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এবার চালের উৎপাদন ৪ কোটি টন ছাড়াবে, যা দেশের চাহিদার তুলনায় কমপক্ষে ৪০ লাখ টন বেশি। ফলে চাল আমদানির কোনো দরকার নেই। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে দাম বাড়ছে, তাতে আমদানি করে পোষানো যাবে না। দেশেই চালের উৎপাদন আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
অবশ্য চাহিদা ও উৎপাদনের যে হিসাব দেওয়া হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সব সময়ই চাহিদার চেয়ে উৎপাদন অনেক বেশি বলে উল্লেখ করা হয়। তাহলে আমদানি করতে হয় কেন। ইউএসডিএ বলছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসেই সরকার চাল আমদানির জন্য শুল্ক-কর কমিয়ে দিয়েছিল। সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে হারটি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ শতাংশ। তবে চাল আমদানিতে আমদানিকারকদের আগ্রহ দেখা যায়নি। কারণ, বিশ্ববাজারে দাম বেশি এবং দেশেও ডলার-সংকট রয়েছে।
দেশে এবার চালের উৎপাদন ৪ কোটি টন ছাড়াবে, যা দেশের চাহিদার তুলনায় কমপক্ষে ৪০ লাখ টন বেশি। ফলে চাল আমদানির কোনো দরকার নেই।মো. শাহজাহান কবীর, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক
কৃষি মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে বোরো মৌসুমে ধান ও চালের উৎপাদন ব্যয়ের হিসাব চূড়ান্ত করেছে। তাতে দেখা গেছে, এবার প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ পড়েছে ৩১ টাকা ৬০ পয়সা। আর চাল উৎপাদনে ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ টাকা, যা গত বছরের তুলনায় কেজিতে প্রায় ৩ টাকা বেশি।
বাংলাদেশে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বোরোতে ১ কেজি চাল উৎপাদনের খরচ এর আগের বছরের তুলনায় ৩ টাকা বেড়ে প্রায় ৪১ টাকা হয়। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
ইউএসডিএ বলছে, গত বছর সরকার সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়ায়। এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সেচের খরচ বাড়িয়েছে। গত আমন মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি কম হওয়ায় কৃষককে কৃত্রিম সেচ দিতে হয়েছে। বোরোতে অতিরিক্ত তাপমাত্রা থাকায় সেচে বাড়তি খরচ হয়েছে। এবার বোরোতে কৃষিশ্রমিকের মজুরি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি ছিল। বীজের দাম বেশি পড়েছে। সব মিলিয়ে চালের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
বাংলাদেশ অটো, হাসকিং, মেজর চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে নতুন ধান উঠলেও দাম এখনো কমেনি। ফলে চালের দামও কমছে না। তিনি বলেন, দাম এখনকার তুলনায় বেশি কমে গেলে কৃষক, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ী—সবাই লোকসানে পড়বেন। উৎপাদন খরচ তো ওঠাতে হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে চালের সরকারি মজুত ছিল ৮ লাখ ৭৭ হাজার টনের বেশি। দেশে ধান আবাদের মৌসুম তিনটি—বোরো, আমন ও আউশ। বোরো মৌসুমে প্রায় ২ কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়, যা মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি।
চালের উচ্চ মূল্য বিপাকে ফেলে নিম্ন আয়ের মানুষকে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখিয়েছিল, অতি গরিব শ্রেণিভুক্ত একজন মানুষ তাঁর ব্যয়ের ৩২ শতাংশ খরচ করেন চাল কিনতে। গরিব মানুষের ক্ষেত্রে এই হার ২৯ শতাংশ। এ ছাড়া গরিব নন, এমন ব্যক্তি তাঁর ব্যয়ের এক-পঞ্চমাংশ চাল কেনায় খরচ করেন।
দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের কম দামে চাল বিক্রি ও খাদ্যসহায়তার বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। সরকার গত বছরের জুন থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত এসব কর্মসূচির আওতায় প্রায় ২০ লাখ ৪৬ হাজার টন চাল বিতরণ করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৪ শতাংশ বেশি। যদিও বিপুলসংখ্যক মানুষ এসব কর্মসূচির আওতার বাইরে থেকে যায় বলে মনে করা হয়। কারণ, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তিন কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন।
চালের উচ্চ মূল্য বিপাকে ফেলে নিম্ন আয়ের মানুষকে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখিয়েছিল, অতি গরিব শ্রেণিভুক্ত একজন মানুষ তাঁর ব্যয়ের ৩২ শতাংশ খরচ করেন চাল কিনতে।
চালের মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। কারণ, মূল্যস্ফীতির হিসাবের ক্ষেত্রে চালকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এদিকে চালের বাজারে কারসাজি ও কৃত্রিমভাবে মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে সরকার এখন বস্তায় জাতের নাম লিখে দেওয়া এবং সারা দেশে জাতভেদে দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, চাপ প্রয়োগ করে ও দাম বেঁধে দিয়ে চাল ও অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম কমানো যাবে না। বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। এককভাবে কয়েকটি কোম্পানির কাছে চাল ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ যাতে কুক্ষিগত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, চালের বাজারে এখন নগদ অর্থের প্রবাহ, সহজ ব্যাংকঋণ এবং প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, বাজারে যাতে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতা করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে পারলে দাম যৌক্তিক পর্যায়ে থাকবে।