কুমিল্লায় বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে চাকরি করতেন মো. ইয়াকুব লস্কর। ২০১৮ সালে অবসরে যাওয়ার তিন মাস আগে তিনি স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
দীর্ঘ রোগভোগের পর গত বছরের নভেম্বরে ইয়াকুব মারা যান। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তাঁর যত্নআত্তি, চিকিৎসাসহ সংসারের হাল ছিল স্ত্রী ও তিন মেয়ের ওপর।
ইয়াকুবের কথা বলতে গিয়ে তাঁর মেয়ে রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা কর্মজীবী নারী ফারহানা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তাঁরা বড় ধরনের হোঁচট খান। কিন্তু মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে মা ও তিন বোন শক্তভাবে সংসারের হাল ধরেন।
প্রতিবেদন তৈরির কাজে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় যান এই প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে দেখা হয় কয়েক নারীর সঙ্গে, যাঁদের স্বামী মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে গেছেন। আর দেশে সংসারের সবকিছু সামলাচ্ছেন এই নারীরা। তাঁরা নিজেরাও আয় করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
তেমনই এক নারী মোসাম্মৎ আমেনা খাতুন। তিনি বলছিলেন, প্রথম ছয় মাস তাঁর স্বামী কোনো অর্থ পাঠাতে পারেননি। তা ছাড়া স্বামীকে বিদেশে পাঠাতে গিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ করতে হয়েছে। তিনি তাঁতের কাজ করে তিন সন্তানসহ সংসারের খরচ চালিয়েছেন, ঋণের কিস্তি টেনেছেন। এখনো সংসার সামলাতে তাঁর আয় বড় ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০০৪, ২০১১ ও ২০২৩ সালের আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপের তথ্য অনুসারে, গত প্রায় দুই দশকে নারীপ্রধান পরিবারের হার বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বাড়ির পুরুষদের বিদেশে ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের কারণে এ সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এ ছাড়া পরিবারে পুরুষ না থাকা, অসুস্থতা, অন্য কোনো কারণে তাঁর (পুরুষ) কাজে যুক্ত না থাকা বা একা নারীরা পরিবারের প্রধান হিসেবে সংসারের হাল ধরেছেন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পরিবারগুলো মাতৃপ্রধান হওয়ার রীতিও নারী পরিবারপ্রধানের হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসারে জনশুমারি ও গৃহগণনা জরিপের পর প্রতিবার আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ করা হয়। দেশে ২০০১ সালের জনশুমারির বেশ পরে ২০০৪ সালে আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ হয়। তবে তা প্রকাশ হয় ২০০৮ সালে। এই জরিপ অনুসারে, দেশে পুরুষপ্রধান পরিবারের হার ছিল প্রায় ৯২ শতাংশ। নারীপ্রধান পরিবারের হার প্রায় ৮ শতাংশ।
২০১১ সালের আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ অনুসারে, দেশে পুরুষপ্রধান পরিবারের হার ছিল প্রায় ৯১ শতাংশ। নারীপ্রধান পরিবারের হার প্রায় ৯ শতাংশ।
জনশুমারি ও গৃহগণনা জরিপ ২০২২-এর পর চলতি বছরের ৫ জুন প্রকাশিত আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ ২০২৩। জরিপ অনুসারে, দেশে পুরুষপ্রধান পরিবারের হার প্রায় ৮৫ শতাংশ। আর নারীপ্রধান পরিবারের হার প্রায় ১৫ শতাংশ। গ্রামে নারীপ্রধান পরিবারের হার ১৩ শতাংশ। শহরে এ হার প্রায় ১৫ শতাংশ।
২০১১ সালের জরিপে পুরুষ ও নারীপ্রধান পরিবারে সদস্য কারা, কোন বয়সী নারীরা বেশি সংখ্যায় পরিবারপ্রধান, তার বিশ্লেষণ ছিল। তবে অন্য দুটি জরিপে তা নেই। ২০১১ সালের জরিপ অনুসারে, নারীপ্রধান পরিবারের প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৫৪ বছর বয়সী নারী ছিলেন পরিবারপ্রধান। নারীপ্রধান পরিবারে স্বামীর হার ছিল প্রায় ৩ শতাংশ। আর পুরুষপ্রধান পরিবারে স্ত্রীর হার ছিল ২৭ শতাংশ। এ ছাড়া দুই ধরনের পরিবারেই সন্তান, মা–বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, পুত্রবধূ, জামাতা, ভাই, বোন, দেওর, ননদসহ আত্মীয়-অনাত্মীয় ছিলেন।
আর্থসামাজিক ও জনমিতি জরিপে অনেক বেশি প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবারের জরিপটি গত বছরের ২১ মে থেকে ২২ জুন পর্যন্ত পরিচালিত হয়। জরিপে ১৩টি বিষয়ভিত্তিক মডিউলের আওতায় ১২১টি প্রশ্নের মাধ্যমে ১৯৪টি সূচকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ১২ হাজার ৪০টি এলাকার ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৩৪টি পরিবার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
বিবিএসের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদনেও নারী পরিবারপ্রধানের একটি চিত্র পাওয়া যায়। ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, নারী পরিবারপ্রধানের হার ১৭ শতাংশ। ২০২১ সালে ১৬, ২০২০ সালে ১৫, ২০১৯ সালে প্রায় ১৫ ও ২০১৮ সালে ১৪ শতাংশ পরিবার নারীপ্রধান ছিল।
শুধু পরিস্থিতির কারণে পরিবারপ্রধান হলে নয়, আর্থিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে এবং পরিবারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারলে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ প্রকল্পের পরিচালক মো. দিলদার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অভিবাসনের কারণে অনেক পুরুষ বিদেশে থাকেন। সে সময় পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কিছু ক্ষেত্রে হলেও নারী ক্ষমতা পান। আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচির মাধ্যমে নারীর এই ক্ষমতায়ন না হলেও এটাকে ইতিবাচক প্রবণতা বলা যায়।
প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে দিলদার হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগে প্রবাসী আয় বেশি। সেখানে নারী পরিবারপ্রধানের হারও বেশি।
নতুন আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ অনুসারে, চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ ২১ শতাংশ নারীপ্রধান পরিবার রয়েছে। ঢাকা ও সিলেট বিভাগে এ হার ১৫ শতাংশ। এ হার সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগে, মাত্র ৯ শতাংশ। বাকি চার বিভাগে এ হার ১০ থেকে ১১ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, পুরুষের অভিবাসন নারীপ্রধান পরিবার বাড়ার বড় কারণ। একা জীবন যাপন করা, পরিবারকে সহায়তা করার মতো সক্ষমতা তৈরি হওয়া এবং নির্যাতনের মধ্যেও বৈবাহিক সম্পর্ককে ধরে না রেখে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রবণতা বাড়ার কারণেও নারী পরিবারপ্রধান বাড়ছে।
পুরুষের চেয়ে নারীরা পরিবারের প্রতি অনেক বেশি যত্নশীল বলে উল্লেখ করেন তানিয়া হক। তিনি বলেন, এ কারণে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারী পরিবারপ্রধান হলে তা পরিবারের জন্য আরও কল্যাণকর। যাঁরা নারীর আয় নিয়ে ও নারীর পরিবারপ্রধান হওয়া নিয়ে সমালোচনা করেন, তাঁদের এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত।