মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির লড়াই চলছে প্রায় দুই মাস ধরে। বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তের ওপারেই রাখাইন রাজ্য। সেখানে দুই পক্ষের সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তে প্রয়োজনে বাড়তি জনবল নিয়োগ করতে সরকার বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে নির্দেশ দিয়েছে। তবে মিয়ানমার সীমান্তে এখনই সেনা মোতায়েনের কথা ভাবছে না সরকার।
গতকাল রোববার বিকেলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এর আগে গতকাল দুপুরে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব খুরশেদ আলম বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। বাড়তি জনবলের প্রয়োজন হলে তারা সেটা মোতায়েন করবে। সাগরপথে বা স্থল সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নতুন করে রোহিঙ্গারা যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে বলা হয়েছে। এর আগেরবার মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আসার সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু লোকজনের যোগসাজশ ছিল। এবার যাতে সেটা না হয়, সে জন্য সব সংস্থাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশ সেনা মোতায়েনের কথা ভাবছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, এই মুহূর্তে সরকার সেনা মোতায়েনের কথা ভাবছে না।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার মিয়ানমারের দিক থেকে ছোড়া মর্টারের গোলা সীমান্তের শূন্যরেখায় (বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রুর কাছে) রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে এসে পড়ে। এতে এক রোহিঙ্গা কিশোর নিহত ও কয়েকজন হতাহত হন।
নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তে উত্তেজনার পরিস্থিতি অতিক্রম করে এখন হালকা উসকানিমূলক সংঘাতের দিকে যাচ্ছে মিয়ানমার। আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর লড়াই অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতর চলে আসছে। বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে মর্টার শেল ও গ্রেনেড পড়ার পাশাপাশি আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াইকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাংলাদেশকেও একভাবে জড়িয়ে ফেলতে চাচ্ছে।
চতুর্থ দফায় মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে তলব
ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে গতকাল সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুবিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. নাজমুল হুদার দপ্তরে তলব করা হয়। সীমান্তে অনাহূত পরিস্থিতির কারণে গত এক মাসের মধ্যে এ নিয়ে চারবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হলো।
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব মো. খুরশেদ আলম বলেন, সীমান্তে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেসবের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ লিপি দিয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের গোলা যেন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে না আসে, সেটা দেখার দায়িত্ব মিয়ানমারের। বাংলাদেশ একটি দায়িত্বশীল ও শান্তিকামী রাষ্ট্র। অনেক দিন ধরে অনেক ধৈর্য ধরেই সহ্য করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে এখানে কোনো রক্তারক্তি ও প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে।
এর আগেও তো তিনবার মিয়ানমারের দূতকে তলব করা হয়েছিল। এতে কী ফল হচ্ছে, জানতে চাইলে খুরশেদ আলম বলেন, ‘প্রতিবেশীকে নিয়মমাফিক যা করার, সেটাই করছি। মিয়ানমারের কাছে আমাদের কথাবার্তা ও যে বক্তব্য দিয়েছি, সেখানে কোনো রকম দুর্বলতা বা নতজানুতা নেই। বরং আমরা শক্ত অবস্থানে থেকেই নিজেদের কথা বলেছি। আমরা চেষ্টা করছি ঢাকায় আসিয়ানের (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের আঞ্চলিক জোট আসিয়ান। এর সদস্য মিয়ানমার, তবে বাংলাদেশ এই জোটে নেই) রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফ করতে। যাতে তাদের বলতে পারি যে বারবার একই অবস্থা শুনে গিয়ে মিয়ানমারের কোনো ব্যবস্থা না নেওয়াটা প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমরা চাই না এসবের পুনরাবৃত্তি ঘটুক।’
তলবের জবাবে মিয়ানমারের দূত কী বলেছেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, রাষ্ট্রদূত সব বিষয় শুনেছেন। কোনো বিষয়ে না করেননি। স্পষ্টভাবে কোনো জবাব নেই। এ তথ্য নেপিডোতে (মিয়ানমারের রাজধানী) জানাবেন, যাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।
অতীতে তলবের পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কী জবাব এসেছিল, জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব খুরশেদ আলম বলেন, গুলির গায়ে মিয়ানমার আর্মি লেখা থাকলেও মিয়ানমার বলছে, গুলি করেছে আরাকান আর্মি। তারা সেনাবাহিনীর গুলি চুরি করে নিয়ে গেছে। আরাকান আর্মি এটা করছে, যাতে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়, এমনটাই বলেছে মিয়ানমার।
দফায় দফায় তলবের পরও সীমান্ত পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না, এমন এক প্রশ্নে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কী হচ্ছে? পাঁচ বছর ধরে জাতিসংঘ থেকে এমন কোনো বড় দেশ নেই, এমন কোনো জায়গা নেই, যাদের কাছে যাইনি, ধরনা দিইনি, কথা বলিনি। সমস্যার সমাধান তো হয়নি। ইউএনএইচসিআর (জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা) কি পেরেছে? কাজেই দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সমাধানে সময় লাগবে, ধৈর্য ধরতে হবে।’