২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর ছয়টা। কুশায়ামাখা সেই ভোরে বাবার শ্রাদ্ধ শেষে মন্দির থেকে বাড়িতে ফেরার পথে চকরিয়ার মহাসড়কের পাশে দাঁড়ালেন সাত ভাই ও এক বোন। এমন সময় একটি দ্রুতগতির পিকআপ দাঁড়ানো আটজনকে একসঙ্গে চাপা দিয়ে কিছু দূর এগিয়ে যায়। বাঁচার আকুতিতে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশ। আবার গাড়িটি পেছনে আসে, মানুষগুলোকে দ্বিতীয় দফায় চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই নিহত হন পাঁচ ভাই। আহত হন এক বোন ও দুই ভাই। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আহত এক ভাই। অন্য দুজন দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এই মর্মান্তিক ঘটনার এক বছর চার মাস পর গতকাল রোববার রায় ঘোষণা করেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। রায়ে ঘটনাটি ‘দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করে আদালত চালক সাহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দেন। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে আসামির উপস্থিতিতে আদালতের বিচারক এ রায় ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তাঁকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ‘পিকআপচালক প্রথমবার চাপা দেওয়ার পর দ্বিতীয়বার পেছন থেকে আহত ব্যক্তিদের চাপা দিয়ে ঘটনাস্থলে মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন। এ জন্য চালক সাহিদুলের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু চালকের বয়স (২২) বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো।’
আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার অন্য দুই আসামি পিকআপের মালিক মাহমুদুল করিম ও তাঁর ছেলে মো. তারেকের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইনে বিচার হবে। সাক্ষ্য শুরুর অপেক্ষায় আছে সেটি। আজকের (গতকাল) রায়টি শুধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে।’
গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাটের হাসিনাপাড়া এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে পিকআপের চাপায় নিহত হন সুরেশ চন্দ্র সুশীলের ছয় ছেলে অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫), রক্তিম সুশীল (৩২), চম্পক সুশীল (৩০) ও স্মরণ সুশীল (২৯)। এ ঘটনার আগে ৩০ জানুয়ারি তাঁদের বাবা সুরেশ চন্দ্র সুশীল মারা যান। ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে মালুমঘাটের একটি মন্দিরে বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পথে তাঁরা এ ঘটনার শিকার হন।
পুলিশ জানায়, ছয় ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁদের বেঁচে যাওয়া ভাই প্লাবন সুশীল বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। ঘটনার তিন দিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন চালক সাহিদুল ইসলাম। পরে পিকআপের মালিক মাহমুদুল করিম গ্রেপ্তার হলেও তিনি এখন জামিনে আছেন। আর তাঁর ছেলে মো. তারেক পলাতক।
আদালত সূত্র জানায়, তদন্তের পর গত বছরের ৯ নভেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক এনামুল হক চৌধুরী তিনজনের বিরুদ্ধে হত্যা ও সড়ক পরিবহন আইনে পৃথক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি চকরিয়ার জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত শুনানি শেষে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, পিকআপের মালিক মাহমুদুল করিম অনভিজ্ঞ ও লাইসেন্সবিহীন একজন চালকের হাতে গাড়িটি চালানোর জন্য তুলে দিয়েছেন, যা সড়ক পরিবহন আইনের পরিপন্থী। এ ছাড়া দুর্ঘটনার খবর শুনেও তিনি (মাহমুদুল) আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার উদ্যোগ নেননি। এ জন্য মাহমুদুলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনার সময় মাহমুদুলের ছেলে মো. তারেক পিকআপে চালকের পাশে বসা ছিলেন। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার না করে উল্টো তিনি চালককে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। এ জন্য তাঁকেও আসামি করা হয়েছে। চালক সাহিদুল ইচ্ছাকৃতভাবে জেনে–বুঝে গাড়িটি পেছনের দিকে চালান এবং ঠান্ডা মাথায় তিনি এটা সম্পন্ন করেন। তাঁর উচিত ছিল, প্রথমবার চাপা দেওয়ার পর আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া বা পুলিশকে খবর দেওয়া। কিন্তু তা না করে তিনি আহত ব্যক্তিদের দ্বিতীয়বার চাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়েছেন।
মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বয়স বিবেচনায় নিয়ে আদালত সাহিদুলকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন। নইলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতো। এ ধরনের রায় দেশে এটাই প্রথম।’
মামলার বাদী প্লাবন সুশীল বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন। রায় নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে মামলার রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি একসঙ্গে ছয় সন্তান হারানো মা মৃণালিনী সুশীল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পিকআপচালক ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর ছয় ছেলেকে হত্যা করেছেন। তাঁর মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল। শিগগিরই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।