বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক শুধু ভৌগোলিক সীমান্তের মধ্যে আবদ্ধ নয়, নানা ক্ষেত্রে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলও। তবে নানাবিধ সমস্যাও আছে। তাই দুই দেশের মধ্যে যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধান করতে হবে। এ জন্য কোনো কিছু আড়াল না করে আন্তরিকতা নিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্ক ও গণমাধ্যমের ভূমিকা: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে এসব কথা বলা হয়। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতীয় প্রেসক্লাবের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এই সেমিনারের আয়োজন করে প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ। আলোচনা সভায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ দুই দেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও একজন আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক অধ্যাপক বক্তব্য দেন।
সেমিনারে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, বৈশ্বিক সংকটময় রাজনীতির নতুন যে সমীকরণ সেখানে বাংলাদেশ ও ভারত শুধু ভৌগোলিক সীমান্তের সম্পর্কেই আবদ্ধ নয়। বরং ৫০ বছর ধরে দুই দেশের অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য ও যোগাযোগব্যবস্থাসহ নানা ক্ষেত্রে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার এবং জনগণের সহযোগিতা ও অবদান বাংলাদেশ সব সময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
গণমাধ্যমের ভূমিকা ও গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে স্পিকার বলেন, গণমাধ্যমের প্রসার গণতন্ত্রকে সুসংহত করে।
সেমিনারে সম্মানিত অতিথি ছিলেন ভারতীয় সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি গীতার্থ পাঠক। তিনি বলেন, দুই দেশের অভিন্ন ইতিহাস ও সংস্কৃতি আছে। দুই দেশের এসব অভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্যকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভারত ও বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
তিন বিঘা করিডোর থেকে শুরু করে ফারাক্কা, তিস্তার পানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যার কথা উল্লেখ করে গীতার্থ পাঠক বলেন, আন্তর্জাতিক পানি বিভাজনের নিয়ম কেউ মানছে না। নিম্নাঞ্চলের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পানির সমস্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এই সমস্যার বিষয়ে ওপরের রাষ্ট্র যদি স্বীকৃতি দেয় এবং এগিয়ে যায়, তাহলে সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যাবে।
আরেক সম্মানিত অতিথি ডেইলি স্টার সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনাম মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের সহায়তা এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেই সব দিনের স্মৃতিচারণা করেন। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে অনেক জটিলতা আছে। কিন্তু ইতিহাসের এই অধ্যায়টুকু যেন না ভুলে যাই। তিনি দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মাহ্ফুজ আনাম বলেন, মানুষের মধ্যে সম্পর্ক হলে সেটি টেকসই হয়। আর এ জন্য গণমাধ্যমকে বিরাট ভূমিকা রাখতে হবে।
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের যে বিভিন্ন দিক আছে, সেগুলো অত্যন্ত জটিল। নানাবিধ সমস্যার সঙ্গে জড়িত। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশও জিতবে, ভারতও জিতবে—এমনভাবে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এ জন্য বিষয়গুলো আন্তরিকতার সঙ্গে সামনে আনতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমস্যাকে তিনটি ভাগে ভাগ করে মাহ্ফুজ আনাম বলেন, এর মধ্যে একটি হলো নিরাপত্তাবিষয়ক। একসময় ভারত বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিল। ধন্যবাদ ও প্রশংসা যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারতের নিরাপত্তাবিষয়ক বিষয়গুলো যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ও সফলতার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় সমস্যা হলো পানিবণ্টন বা বিনিময়। এ নিয়ে অসম্পূর্ণতা আছে, বাংলাদেশের আক্ষেপ আছে এবং অনেক কিছু বলার আছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর যে গঙ্গা চুক্তি করলেন, সেটিও মাইলফলক। কিন্তু সেই মাইলফলক দৃষ্টান্ত পরপর্তী সময়ে অতটা মজবুত হয়নি। দুই দেশের মধ্যে ৫০টির বেশি নদী আছে। প্রতিটি নদীর পানির সুষম বণ্টনের বিষয়ে চুক্তিতে আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ ভারত সফরের সময় কুশিয়ারা নিয়ে একটি সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু তিস্তা চুক্তি রয়েই যাচ্ছে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটি বিরাট অস্পূর্ণতা, দুঃখ রয়েছে, যা গভীর আকার ধারণ করছে। পানিবণ্টন একটি বড় ইস্যু। মাহ্ফুজ আনাম বলেন, তৃতীয় বিষয় হলো দুই দেশেই অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। এই তিনটি বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই তিন বিষয়েই সাংবাদিকদের বিরাট ভূমিকা পালন করতে হবে।
ভারত বিষয়ে জানা ও বিশ্লেষণ করা এবং তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশেষায়িত ইনস্টটিউট করার পরামর্শ দেন মাহ্ফুজ আনাম।
সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক হতে হবে দুই দেশের মানুষের মধ্যে। প্রেসক্লাবের সদস্য আইয়ুব ভুইয়ার সঞ্চালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রেসক্লাবের সাধারণ সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে অনুষ্ঠিত হয় কার্য অধিবেশন। সেখানেও ঘুরেফিরে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এই অধিবেশনে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা ছাড়াও ভারত থেকে আসা কয়েকজন সাংবাদিক বক্তব্য দেন।
এই পর্বের অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার সঞ্চালনায় এই পর্বের অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রেসক্লাব অব ইন্ডিয়ার সাবেক সভাপতি গৌতম লাহিড়ি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহুয়া চ্যাটার্জি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, ভারতের আগরতলা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রণব সরকার প্রমুখ। এই পর্বের অনুষ্ঠানেও সভাপতিত্ব করেন প্রেসক্লাব সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন।