নির্দেশিকা প্রকাশ: ভ্রূণের পরিচয় জানার প্রযুক্তি এখন সারা দেশে। ব্যবহারের ক্ষেত্রে পেশাজীবীদের সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
মেয়েশিশুর চেয়ে ছেলেশিশুকে অগ্রাধিকার বেশি দিচ্ছেন মা ও বাবা। এমন পরিস্থিতিতে মেয়ে ভ্রূণ বৈষম্যের শিকার হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ভ্রূণের প্রতি পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ না হলে সমাজে লিঙ্গবৈষম্য ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঝুঁকি বাড়বে।
মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ছেলের ব্যাপারে অগ্রাধিকার প্রতিরোধ এবং পক্ষপাতিত্বমূলক লিঙ্গ বাছাইয়ের ঝুঁকিবিষয়ক জাতীয় নির্দেশিকার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গবেষক ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিনিধিরা এ কথা বলেন। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ইউএনএফপিএ ও ঢাকার নরওয়ে দূতাবাস যৌথভাবে এই প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ভ্রূণের লিঙ্গ শনাক্ত করতে পারেন, এমন স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে।
অনেক দেশেই মেয়ে ভ্রূণ হত্যা করা হয়, অবহেলা দেখানো হয় মেয়ে নবজাতকের ক্ষেত্রে। এসব কারণে ২০২০ সালে বিভিন্ন দেশের ১৪ কোটি মেয়েশিশু বৈশ্বিক জনসংখ্যায় যুক্ত হতে পারেনি। ভ্রূণের প্রতি পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিকভাবে নারী ও পুরুষের অনুপাত ১০০ ও ১০৫। সমাজ ও ভৌগোলিক অবস্থানভেদে এই অনুপাতে সামান্য তারতম্য হতে পারে। আনুপাতিক হারে নারী যদি বেশি কমে যেতে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে ভ্রূণ হত্যার মতো কোনো ঘটনা হয়তো ঘটছে।
তিনটি বিষয়ের উপস্থিতি বলে দেয়, মেয়ে ভ্রূণের প্রতি বৈষম্য হচ্ছে কি না। মোট প্রজনন হার যদি কমে যেতে থাকে অর্থাৎ প্রজননক্ষম নারী যদি দুটি বা দুটির কাছাকাছি সন্তান জন্ম দেন, তা হলে ছেলেসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, অনেক সমাজে ছেলেসন্তানের ব্যাপারে আনুকূল্য থাকে। তৃতীয়ত, ভ্রূণের লিঙ্গ শনাক্তের প্রযুক্তির সহজলভ্যতা। এই তিনটি শর্তই বাংলাদেশ এখন পূরণ করছে বলে মন্তব্য করেন মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম।
*প্রথম সন্তান ছেলে চান ২৮% নারী ও ২৪% পুরুষ * প্রথম সন্তান মেয়ে চান ১২% নারী ও ১০.৪% পুরুষ *আর ৩৪% মা ভ্রূণের লিঙ্গ পরিচয় জানতে আগ্রহী
ইউএনএফপিএর সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন , প্রথম সন্তান ছেলে হোক—এটি চান ২৮ শতাংশ নারী ও ২৪ শতাংশ পুরুষ। অন্যদিকে প্রথম সন্তান মেয়ে হোক—এটি চান ১২ শতাংশ নারী ও ১০ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ। ওই গবেষণায় ৩৪ শতাংশ নারী ভ্রূণের লিঙ্গ জানার জন্য চিকিৎসাপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে মোট প্রজনন হার এখন ২ দশমিক ৩। এই সবই মেয়ে ভ্রূণের প্রতি বৈষমের পূর্বাভাস। তিনি বলেন, আরও একাধিক গবেষণায় বাংলাদেশে মেয়ে ভ্রূণের প্রতি বৈষমের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।াস। তিনি বলেন, আরও একাধিক গবেষণায় বাংলাদেশে মেয়ে ভ্রূণের প্রতি বৈষমের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ভ্রূণ অবস্থায় লিঙ্গ পরিচায় যেন গোপন থাকে, সে জন্য চিকিৎসক, চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ বা স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নির্দেশিকা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। অনুষ্ঠানে নির্দেশিকার বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীর। তিনি বলেন, প্রসূতিবিশেষজ্ঞ, জিনবিষয়ক চিকিৎসক, শিশুবিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, রেডিওলজিস্ট, মিডওয়াইফ, পরিবারকল্যাণ সহকারী, সাব–অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা, সনোলজিস্ট, নার্স ও প্রযুক্তিবিদ—সবাইকে ভ্রূণের লিঙ্গ শনাক্ত না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। মানুষকে সচেতন করার ব্যাপারেও তাঁদের ভূমিকা রয়েছে।
অনুষ্ঠানে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ক্রিস্টিন ব্লখুস বলেন, ১৪ কোটি নারী হারিয়ে যাওয়ার অর্থ তাদের জন্ম নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু জন্ম নিতে পারেনি। এর অর্থ তারা বৈষমের শিকার হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে সমাজ তাদেরকে কম গুরুত্ব দিয়েছে, কম মূল্য দিয়েছে। অন্যদিকে বৈষম্যের কারণে পুরুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অনেক দেশে বা সমাজে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, নারীর প্রতি সহিংসতাও বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, ভালো খবর হচ্ছে এই যে বাংলাদেশ এখনো ওই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তবে ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, সরকার মেয়েদের জন্য অনেক সুযোগ–সুবিধা দিয়েছে। মেয়ে এখন পরিবারের জন্য আশীর্বাদ। তবে এ বিষয়ে মানুষের ধারণার ঘটতি রয়েছে। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নরওয়ে দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স সিলজে ওয়ানেবো এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) রাশেদা সুলতানা।