উৎপাদন করলেও দিতে হয়, না করলেও দিতে হয় সক্ষমতার ভাড়া। চাহিদা ও জ্বালানির অভাবে বসে থাকছে অনেক কেন্দ্র।
পরিকল্পনা অনুসারে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। কিন্তু সে অনুযায়ী বাড়েনি চাহিদা। তাই নিয়মিতই বসিয়ে রাখতে হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর বর্তমানে জ্বালানিসংকটের এ সময়ে চাহিদামতো কাজে লাগানো যাচ্ছে না উৎপাদন সক্ষমতা। কিন্তু উৎপাদন হোক বা না হোক, চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্র ভাড়া পাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে প্রতিবছর বাড়ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসানের বোঝা। বাড়ছে দেনার চাপ।
পিডিবি সূত্র বলছে, গত অর্থবছরের (২০২১-২২) ঘাটতি মেটাতে অর্থ বিভাগের কাছে ২৮ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে পিডিবি। এখন পর্যন্ত তারা পেয়েছে ৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বাকি ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকার জন্য বারবার চিঠি দিয়েও অর্থ বিভাগের কোনো সাড়া পাচ্ছে না। এতে অর্থের অভাবে পড়েছে পিডিবি। কয়েক মাস ধরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল বকেয়া রেখেছে তারা।
তবে পিডিবিকে ঢালাওভাবে ভর্তুকি দিতে চায় না অর্থ মন্ত্রণালয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার ভাড়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে তারা। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে করা পিডিবির চুক্তি পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে।
উৎপাদন সক্ষমতা এবং উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের দাম, লোকসান ও ভর্তুকি বেড়েছে। অথচ ভোক্তা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। উন্নয়ন করতে গিয়ে সর্বনাশ হয়েছে এ খাতে।এম শামসুল আলম, জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব
পিডিবির ভর্তুকির বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দর্শন হচ্ছে, নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট। বিদ্যুৎ না নিয়ে বিল দেওয়ার ঘোরবিরোধী আমি। পিডিবির কত টাকা আটকে আছে, কেন দেওয়া হচ্ছে না; খোঁজ নিয়ে দেখব।’
এর মধ্যেই চলছে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া। পাইকারি পর্যায়ে পিডিবির ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। যদিও সরকারি ভর্তুকি ছাড়া গড়ে ৫৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বিইআরসির কারিগরি কমিটি। শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে পারে বিইআরসি। এর আগে গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১০ বার। এতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আর খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ।
পিডিবির লোকসান ও দায়দেনা নিয়ে কথা বলতে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। গত বুধবার দুপুরে বিদ্যুৎ ভবনে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে বসে থাকার পরও কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
দেশের সরকারি ও বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। প্রতিটি কেন্দ্রের সঙ্গে পিডিবির আলাদা চুক্তি আছে। এ চুক্তিতে বিদ্যুৎ কিনে নেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎ দিতে না পারলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পিডিবিকে জরিমানা দেয়। আর পিডিবি বিদ্যুৎ কিনতে না পারলেও কেন্দ্র ভাড়া নিয়মিত শোধ করতে হয়। এই কেন্দ্র ভাড়া ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের ঘাটতি থাকায় তেল আমদানি বেড়েছে। গত বছরের জুন থেকে ফার্নেস তেলে সরকার আমদানি শুল্ক কর চালু করেছে। এতে খরচ বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। গত জুলাই থেকে কয়লার ওপর ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা হয়েছে। কয়লার দামও বেড়েছে বিশ্ববাজারে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় কয়েক মাস ধরে পিডিবির উৎপাদন ব্যয় আরও বেড়ে গেছে।
তিন মাস আগেও প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় খরচ ছিল সাড়ে ৮ টাকা। এখন এটি ৯ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জ্বালানির বাড়তি দামের সঙ্গে প্রতিবছর বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের সক্ষমতার ভাড়া। এ অবস্থায় অর্থ বিভাগ থেকে টাকা ছাড় করা না হলে সংকট তৈরি হতে পারে।
পিডিবি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ করলেও গত মার্চ থেকে বিল পাচ্ছে না অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে বকেয়া বিলের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। বিল চেয়ে ইতিমধ্যে পিডিবিকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ)। বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী মালিকদের এ সংগঠন বলছে, স্বাভাবিক সময়ে দুই মাসের বিল বকেয়া থাকে।
বিআইপিপিএর সভাপতি ইমরান করিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় পাঁচ মাসের বিল বকেয়া পড়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এখন দুই মাসের বিল স্বাভাবিক সময়ের চার মাসের বিলের সমান। তিনটি দাবি জানানো হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকের ঋণসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। বিল দ্রুত ছাড় করা ও ডলার ছাড়ে গতি বাড়ানোর দাবি পূরণ হয়নি। বিল দ্রুত ছাড় করা না হলে সমস্যায় পড়বে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।
তবে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পিডিবির পাওনা নিয়ে অর্থ বিভাগের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চলছে। আগামী সপ্তাহে প্রথম কিস্তি ছাড় করার কথা রয়েছে। ধীরে ধীরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার ভাড়া নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে কেন্দ্র ভাড়ার একটি হিসাব দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয়েছে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর আগের অর্থবছরে দিতে হয়েছিল ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকার মতো।
আর শেষ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে দিতে হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সব মিলে ২ বছর ৯ মাসে কেন্দ্র ভাড়া শোধ করা হয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। বছর শেষে এটি ৬০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে জানিয়েছেন পিডিবির এক কর্মকর্তা।
তবে বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, সক্ষমতার ভাড়ার সঙ্গে অলস বসিয়ে রাখার কোনো সম্পর্ক নেই। অনেকে ভুল ব্যাখ্যা দেন। এটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিনিয়োগের সুরক্ষা। একটি কেন্দ্র থেকে কোনো বিদ্যুৎ কেনা না হলে ওই কেন্দ্রের বিনিয়োগ উঠে আসবে না। ব্যাংকের ঋণ শোধ করা যাবে না। তাই সক্ষমতার ভাড়ার বিষয়টি চুক্তিতে বলা থাকে। অন্য দেশেও এটি আছে। সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্রকেই সক্ষমতার ভাড়া দিতে হয়। শেষ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি পেয়েছে ৩ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। আর প্রায় ১২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা পেয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।
দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতা মোট ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছিল গত ২২ এপ্রিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। জ্বালানি সাশ্রয়ে ১৯ জুলাই থেকে ডিজেলচালিত ১ হাজার ৪৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বর্তমানে দিনে উৎপাদন কমে গেছে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট। পিডিবি সূত্র বলছে, গ্যাসের সংকটে অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা যাচ্ছে না। জ্বালানি তেলচালিত কেন্দ্রগুলোও কম চালানো হচ্ছে। ঘাটতি পূরণে রুটিন করে লোডশেডিং করা হচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, শুরু থেকেই চাহিদার প্রক্ষেপণে ভুল থাকায় অতিরিক্ত সক্ষমতা বেড়েছে। আবার উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন তৈরি করা যায়নি। প্রাথমিক জ্বালানির (গ্যাস, কয়লা, জ্বালানি তেল) সরবরাহও নিশ্চিত করা যায়নি। সরকারি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র আনতে না পারায় বেসরকারি খাতের স্বল্প মেয়াদের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মেয়াদ শেষেও চালু রাখতে হয়েছে। এতে পিডিবির খরচ বাড়ছে।
সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত সক্ষমতার জন্য খরচ করতে হচ্ছে। গ্যাস না থাকায় তেল আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। এতে ডলারের রিজার্ভে চাপ বাড়ছে।
বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুসারে এ বছর দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হওয়ার কথা ১৫ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। আর বছর শেষে উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৮৫১ মেগাওয়াট হওয়ার কথা। আগামী পাঁচ বছরে চাহিদার বিপরীতে সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ হবে। এটি অর্থনীতির জন্য বড় বোঝা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো দেশে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি সক্ষমতা রাখা যেতে পারে। তবে পিডিবির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কিছু কেন্দ্র নিয়মিতই রক্ষণাবেক্ষণে রাখতে হয়। গ্যাস–সংকট নিয়মিত বিষয়। জ্বালানির অনিশ্চয়তা আছে দেশে।
তাই ৩০ শতাংশ বাড়তি সক্ষমতা থাকা উচিত। যদিও বর্তমান পরিকল্পনা অনুসারে এগোতে থাকলে সর্বোচ্চ চাহিদার সময়েও ৪৫ শতাংশ সক্ষমতা বসিয়ে রাখতে হবে। আর শীতের সময় বসে থাকবে প্রায় ৭০ শতাংশ সক্ষমতা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, একসময় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, ক্রেতার ওপর উচ্চ মূল্যের অভিঘাত ছিল না। উৎপাদন সক্ষমতা এবং উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের দাম, লোকসান ও ভর্তুকি বেড়েছে। অথচ ভোক্তা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। উন্নয়ন করতে গিয়ে সর্বনাশ হয়েছে এ খাতে।