পাঠ্যবইয়ে সুখী মানুষের গল্পটি যাঁরা পড়েননি, তাঁদের জন্য শুরুতে গল্পটা বলতে চাই। এক দেশে এক ধনী লোকের অসুখ হলো। বড় ধরনের অসুখ। অনেক ডাক্তার-বদ্যি দেখানো হলো। কিছুতেই রোগ সারছে না। এরপর এক চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন, সুখী মানুষের জামা গায়ে জড়ালে ধনী ব্যক্তির অসুখ সারবে। ব্যস, শুরু হয়ে গেলে সুখী মানুষের সন্ধান। খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ—সুখী মানুষের সন্ধান তো মেলে না। অবশেষে এক দেশে এক সুখী মানুষের খোঁজ মিলল। তাঁর কাছে একটি জামা চাইলেন ধনী ব্যক্তির পাঠানো লোকজন। কিন্তু সুখী মানুষ জামা কোত্থেকে দেবে? তার তো জামা নেই। শুধু জামা কেন, কোনো সম্পদই নেই। তাই তো সে সুখী।
আসলেই কী সুখের মূলে আছে প্রাচুর্যহীনতা? একেবারে কিছু না থাকলে, সহায়–সম্বলহীন হলেই কী সুখ মেলে? নাকি সুখের জন্য বিস্তর সহায়–সম্পত্তির দরকার? এ বড় গোলমেলে বিষয়। কে যে কিসে সুখী হয়, তা বোঝা মুশকিল। তবে সুখের মতো একেবারে খুব ব্যক্তিগত, সুক্ষ্ম বিষয়ও এখন মাপা হয়। শুধু মাপা হয় না, এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয় ফি বছর। সেই প্রতিবেদনে যেসব দেশকে সুখী দেশের তালিকায় রাখা হয়, তারা কিন্তু বেশ সম্পদশালীই। সর্বশেষ ২০২২ সালে জাতিসংঘের সুখী দেশের র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম ১০টি সুখী দেশ হচ্ছে ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ, সুইডেন, নরওয়ে, ইসরায়েল ও নিউজিল্যান্ড। এসব দেশের কোনোটিই দরিদ্র বা উন্নয়নশীল নয়। আবার এ তালিকায় আফগানিস্তানকে বিশ্বের সবচেয়ে কম সুখের দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, দরিদ্র।
এটা নিশ্চিত যে ব্যক্তিভেদে সুখের উৎস ভিন্ন। জীববিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, সুখ হচ্ছে একটি জৈব চেতনা। এমন ব্যক্তিগত স্তরে অনুভূতির মাপজোখ বেশ জটিল। তবু প্রতিবছর সুখী দেশের প্রতিবেদন ছাপা হয় আর ২০ মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক সুখ দিবস। এ বছর দিনটির প্রতিপাদ্য, মনোযোগী হোন, কৃতজ্ঞ হোন, দয়ালু হোন।
জাতিসংঘের সুখের যে তালিকাটি করে তা হয় একেকটি দেশ ধরে। তবে সেখানে দেশের নাগরিকদের সঞ্চিত সুখের হিসাব যুক্ত থাকে। ক্ষুধা নিয়ে, যুদ্ধের ভয় নিয়ে, অসহায়ত্ব নিয়ে আর যা–ই হোক সুখে থাকা যায় না, এটা যে কেউ বোঝে। নিরবচ্ছিন্ন সুখ বা দুঃখ মানুষের জীবনে থাকে না। যদিও আমরা পড়েছি, ‘সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা।’ এ ভেলায় ভর করে জীবন চলে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২০১২ সালের ১২ জুলাই ২০ মার্চকে সুখ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সুখ এবং ভালো থাকাকে একটি সর্বজনীন লক্ষ্য ও প্রত্যাশা নিয়েই দিবসটির উৎপত্তি। সুখের মতো মানবিক অনুভূতি সরকারি নীতিতে গুরুত্ব পাবে, দিবসটির মূল লক্ষ্য ছিল এটিই। শুধু তা–ই নয়, সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাভিত্তিক এবং সুষম করাই এর উদ্দেশ্য। অতএব সুখ দিবসের তাৎপর্য বেশ গভীরে।
জাতিসংঘের এ প্রস্তাবটি এনেছিল দক্ষিণ এশিয়ার ভুটান। দেশটি সেই ১৯৭০–এর দশক থেকেই জাতীয় আয়ের চেয়ে জাতীয় সুখকে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে। মোট জাতীয় উৎপাদনের চেয়ে মোট জাতীয় সুখকে তারা প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। যার দৃষ্টান্ত এ গ্রহে বিরল।
এ প্রশ্নটির এককথায় উত্তর নেই। তবে সুখ নিয়ে গবেষণা প্রচুর। সাহিত্য, গান বা শিল্পকলায় সুখ নিয়ে আলোচনার কমতি নেই। আবার দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে সুখের সংজ্ঞা নিয়ে মতদ্বৈততা প্রচুর। প্রয়াত অর্থনীতি আকবর আলী খান তাঁর ‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’ বইতে সুখ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও মনস্তত্ত্ববিদদের দুই দশকের গবেষণার তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। সেখানে সুখের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জন বি শিরিনের দেওয়া সংজ্ঞা তুলে ধরেছেন। ওই সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘সুখ পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত হয় না, সুখ আমাদের ভেতর থেকে উৎসারিত হয়। সুখ রংধনুর মতো নয় যে তা দেখা যাবে। সুখ আগুনের উত্তাপের মতো নয় যে তাকে অনুভব করা যাবে। আমরা নিজেরাই সুখ।’
সুখের এই সংজ্ঞাটি ব্যক্তিগত অনুভূতি হিসেবে সুখের সংজ্ঞা। কিন্তু সুখ কিন্তু শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়। রাষ্ট্র এবং সমাজ সুখের পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই সংজ্ঞায় পরে আসছি।
‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’ বইতে ব্রুনো এস ফ্রে এবং অলিয়েস স্ট্রটজারের দেওয়া ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সুখ পরিমাপের কিছু মজার উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। যেমন বয়স সুখের ক্ষেত্রে একটি বিচার্য বিষয়। যাদের বয়স কম এবং যারা প্রবীণ অথচ শারীরিকভাবে সুস্থ, তাঁরা নিজেদের সুখী মনে করেন। অল্প বয়সীরা না বুঝে কিন্তু প্রবীণেরা বুঝে সুখ অনুভব করেন। সবচেয়ে অসুখী ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা।
নারীদের চেয়ে পুরুষেরা কম সুখী। নারীদের বেশি সুখী হওয়ার কারণ তাঁরা অল্পে তুষ্ট থাকেন।
আবার বিবাহিতরা অবিবাহিতদের চেয়ে নিজেদের সুখী মনে করে থাকে। শিক্ষা এবং সুস্থতার সঙ্গে সুখের সম্পর্ক রয়েছে। যারা যত বেশি শিক্ষিত, তারা তত বেশি সুখী আবার যাদের স্বাস্থ্য ভালো, তারাও তুলনামূলকভাবে সুখী। এ তো গেল সুখের ব্যক্তিগত নানা রকমভেদ।
আকবর আলী খানের বইটিতে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে উদ্ধৃত করে সুখের রাষ্ট্রিক ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘সংবিধান নাগরিকদের সুখের পেছনে ছোটার অধিকার দিয়েছে। আপনাকে সুখকে পাকড়াও করতে হবে।’
অতএব সুখের মতো একেবারে ব্যক্তিগত অনুভূতি নেহাত ব্যক্তিগত নয়। রাষ্ট্রের ভূমিকা সেখানে বড়। আর সেই রাষ্ট্রের ভূমিকার বিচার করে আসছে জাতিসংঘের সুখের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো। গেল পাঁচ বছরে সেসব প্রতিবেদনে প্রতিবছর একটি করে চলমান ইস্যু ধরে সুখের ভূমিকা দেখা হয়েছে। এসব ইস্যুর একটি মাত্রা দেশের বিষয় নয়, এর ব্যাপ্তি বিশ্বময়।
২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে বিশ্বে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ মাসে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। করোনা মহামারি সারা বিশ্বকে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। মানুষের এমন ঘোরতর ‘অসুখ’ নিয়ে ২০২২ সালের বিশ্ব সুখ প্রতিবেদনে আলোচনা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কোভিড ১৯ মানুষের ভালো থাকার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে সেই সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্ব। এর ফলে নারী-পুরুষের ব্যবধান চোখে পড়েছে। প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধানও। তবে এত কিছুর পরও করোনাকালে মানুষের মানবিকতার দিকটি অটুট থেকেছে। ২০২০ সালে মানুষের ভীতি ২০২১ সালে কমেছে বলে এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
২০২১ সালের সুখ প্রতিবেদনেরও প্রতিপাদ্য ছিল করোনা। বরাবরই এ প্রতিবেদনে গ্যালপের বৈশ্বিক জরিপ প্রাধান্য পায়। সেখানে দেখা যায় লকডাউনের সময় মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। তবে এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা বেড়েছে বা এসব প্রতিষ্ঠান তাদের সেই ভূমিকা নিতে পেরেছে। আয়ের অসাম্য এখানে দেশভেদে ভূমিকা রেখেছে। দেখা গেছে, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো উত্তর আটলান্টিকের দেশগুলোর চেয়ে করোনা মোকাবিলা করেছে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে। করোনাকালে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য একটি বড় ইস্যু ছিল, ২০২১–এর প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছিল।
২০২০ সালের বৈশ্বিক সুখ প্রতিবেদনের মূল বিচার্য বিষয় ছিল পরিবেশ। এর মধ্যে প্রাকৃতিক, সামাজিক ও শহুরে প্রতিবেশ আলোচ্য বিষয় ছিল। সেখানে দেখানো হয়েছে, স্থানীয় পরিবেশ মানুষের সুখের ওপর প্রভাব ফেলে। উন্নয়ন যদি টেকসই হয় তবে সুখও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
ডিজিটাল প্রযুক্তি এ সময়ে সুখের নতুন মেরুকরণ উঠে এসেছিল ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে। আর এর নির্বাচনসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনের মূল বিষয় ছিল অভিবাসন। দেখা গেছে, সব অভিবাসন সুখের না বা সব কষ্টের নয়। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে গিয়ে অনেকের সুখ বৃদ্ধি হয়েছে। আবার নিজ দেশে বাধ্য হয়ে অভিবাসিত হয়েছেন, তাঁদের সুখ মেলেনি।
কোভিড ১৯–এর ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ সারা বিশ্বকে এক ভয়াবহ সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দেখা দিয়েছে বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি। বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। মানুষের সুখ যে কমেছে, তা কী আর পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে হবে?