‘আমাদের একটা পাঠাগার আছে, দেখবেন?’—মেয়েটির জিজ্ঞাসায় আগ্রহ বাড়ল। বাল্যবিবাহের কয়েকটি ঘটনার খোঁজ পেয়ে রাজধানীর কড়াইলে গিয়েছিলাম। পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছাতে মেয়েটির সাহায্য নিতে হয়েছিল। বনানীর অভিজাত এলাকার সঙ্গে একদম বিপরীত চিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে কড়াইল। নিম্নবিত্ত লোকজনের বসবাসের ঘিঞ্জি এলাকাটি জালের মতো বিছানো গলিতে ঠাসা। ঘরগুলো একটার সঙ্গে একটা গা ঘেঁষে তোলা। টিনের ঘরগুলোর ওপর টিন দিয়ে অতিরিক্ত ঘর বানিয়ে বাড়তি আয় নিশ্চিত করা হয়েছে। এমন পরিবেশের মানুষদের ‘বঞ্চনার গল্পই’ বেশি শোনা হয়! সেখানে একটি পাঠাগারের এক দশক ধরে টিকে থাকার গল্প আকৃষ্ট করল।
গত ২৬ অক্টোবর কড়াইলের জামাইবাজারে বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া একটি মেয়ে ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে বউবাজারে পাঠাগারের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। গলিগুলো এত সরু যে, কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হেঁটেই চলাচল করতে হয়। গলিগুলোর কোনোটি পেরোতে হয়েছে দোকানের পাশ দিয়ে, কোনোটি কারও ঘরের পাশ দিয়ে। এমন চলতে চলতেই একটি ঘরের সামনে গিয়ে মেয়েটি হাসিমুখে বললেন, ‘এটাই আমাদের পাঠাগার।’ মেয়েটির নাম হালিমা খাতুন। কড়াইলে থাকেন। তাঁর মা একাকী চার ভাইবোনকে বহু কষ্টে বড় করেছেন। হালিমা একটি কলেজে স্নাতক পড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) হয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্যারালিগ্যাল সদস্য হিসেবে কাজ করেন। পাঠাগারের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি স্বেচ্ছাসেবামূলক বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকেন।
কড়াইলে যে ধরনের টিনের ঘর রয়েছে, পাঠাগারটি সে রকম। নাম ‘শহীদ রুমি স্মৃতি পাঠাগার’। হালিমার মতো কড়াইলের অনেক ছেলেমেয়ের কাছে সেটা ‘আমাদের পাঠাগার’। ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর কড়াইলে ৭৫ বর্গফুটের একটি ঘরে যাত্রা শুরু করেছিল পাঠাগারটি। নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও পাঠাগারটি দশক পেরিয়ে টিকে রয়েছে। স্থান পাল্টে পরিসর আরও বড় হয়েছে। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখা গেল, লম্বা ঘরটির তিন পাশজুড়ে বই। এক পাশে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন, সেখানে বাজারের চেয়ে ২০ টাকা কম মূল্যে ন্যাপকিনের প্যাকেট কেনা যায়। হালিমা বললেন, কক্ষের ভেতর বসে পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এক দশক পূর্তি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কারণে চেয়ার-টেবিল এক কোনায় চাপিয়ে রাখা হয়েছে।
গলিগুলো এত সরু যে, কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় হেঁটেই চলাচল করতে হয়। গলিগুলোর কোনোটি পেরোতে হয়েছে দোকানের পাশ দিয়ে, কোনোটি কারও ঘরের পাশ দিয়ে। এমন চলতে চলতেই একটি ঘরের সামনে গিয়ে মেয়েটি হাসিমুখে বললেন, ‘এটাই আমাদের পাঠাগার।’
সংগঠকদের কাছ থেকে জানা গেল, পাঠাগারটিতে আড়াই শতাধিক সদস্য রয়েছেন। বেশির ভাগের বয়স ১৯ থেকে ২০ বছর। সদস্যরা মাসে ২০ টাকা করে চাঁদা দেন। পাঠাগারে চার হাজারের মতো বই রয়েছে। সদস্যের বাইরে সবার জন্য পাঠাগারে পড়া ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বই বাড়িতে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন পাঠক পাঠাগারে আসেন।
স্বপ্ন জাগিয়েছে বই
পাঠাগারের কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখা গেল, এক কিশোর ল্যাপটপে কাজ করছে। নাম রবিউল হাসান (১৭)। সরকারি রূপনগর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সে। রবিউলও কড়াইলের বাসিন্দা। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়। বনানীর একটি ফুটপাতে বাবা মো. নাজিমউদ্দিনের চায়ের দোকান আছে। বাবাকে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিতে সেও চায়ের দোকানে বসে। তবে এক মাস ধরে রবিউল একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।
আলোকচিত্রের কথা বলতে গিয়ে রবিউল বলল, আলোকচিত্রে তার আগ্রহ তৈরি হয়েছে পাঠাগারের এক বই থেকে। সে মূকাভিনয় ও নাটক করে। পাঠাগারের মাধ্যমে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে সদস্যরা। ২০১৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় রবিউল পাঠাগারের সদস্য হয়। বই পড়ার পর তার মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গনে বিচরণের আগ্রহ তৈরি হয়। সামনে কড়াইলের কয়েকটি স্থানে আলোকচিত্র প্রদর্শনী হবে। প্রদর্শনীর জন্য সে ছবি তুলছে পথে রাত কাটানো কুকুর-বিড়ালের। এ জন্য রাত একটার পর থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সে পথে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলে। ছবি তোলার জন্য ক্যানন ইওএস ৭০০ ডি ক্যামেরা সাময়িক সময়ের জন্য দিয়েছে ম্যাপ নামের একটি আলোকচিত্র সংস্থা। কড়াইলের বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী মুনিয়া আক্তার, জনি আক্তার ও আহসান হাবীবও এই প্রদর্শনীর সঙ্গে রয়েছেন। আহসান হাবীব মূকাভিনয়শিল্পীও।
পাঠাগারে প্রবেশের পর থেকে বেশ কয়েকবার লামিয়া আক্তার নামের এক শিশু আসা-যাওয়া করছিল। পাঠাগার লাগোয়া তাদের বাসা। লামিয়া জানায়, ব্র্যাক পরিচালিত স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে সে পড়ে। পাঠাগারে তাদের গল্প পড়িয়ে শোনানো হয়। তার কাছ থেকে শোনা হলো ঘুঘু ও ভোমরার বন্ধুত্বের গল্প।
‘মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ রুমির নামে পাঠাগার দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য, যাতে তাঁর মতো ব্যক্তিস্বার্থ না দেখে সামাজিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া শেখে সদস্য-পাঠকেরা। আমরা এই পাঠাগার তৈরির মাধ্যমে দেখিয়েছি, একদল মানুষকে স্বপ্ন দেখানো সম্ভব। এটা কবির কল্পনা নয় বা রূপকথার গল্প নয়। আমরা একদল কিশোর-তরুণ তৈরি করেছি, যারা অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়ায়।’রাফসানুল এহসান সাজ্জাদ, শহীদ রুমি স্মৃতি পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক
ফেরার পথে হালিমা একটি ভাতের হোটেল দেখিয়ে বললেন, ‘হোটেলটি পাঠাগারের এক সদস্যের মা চালান। আন্টির কাছে পাঠাগারের চাবি রাখা থাকে। যে আগে আসে, সে আন্টির কাছ থেকে চাবি নিয়ে পাঠাগারের দরজা খোলে।’ হালিমা জানান, তিনিসহ অনেকের মনে স্বপ্ন জাগিয়েছে পাঠাগার। এলাকায় বাল্যবিবাহ, নারী-শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা দেখলে তাঁরা প্রতিবাদ করেন।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকা
শহীদ রুমি স্মৃতি পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক রাফসানুল এহসান সাজ্জাদ (৩৭)। ২০১২ সালে কড়াইলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করতেন। ওই সময় একটি গবেষণা প্রকল্পের আওতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে লেকের ওপর মাচা দিয়ে একটি ‘আশার মাচা’ নামে পাঠাগার তৈরি করতে দেখেছিলেন তিনি। লেকের উন্নয়নকাজের সময় পাঠাগারটি বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় রাফসানুলসহ ৫ জন কড়াইলের শিশু-কিশোরদের জন্য ক্ষুদ্র পরিসরে নিজেদের ৫০ থেকে ৬০টি বই নিয়ে পাঠাগার শুরু করেন। পাঠাগারটি এখনো চলছে শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায়। কেউ বই দেন, কেউ অর্থ দেন। পাঠাগারের কক্ষভাড়া মাসে ৮ হাজার ৪০০ টাকা। ২০২০ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সদস্য হওয়ার পর দুবার সরকারি অনুদান পেয়েছে পাঠাগারটি।
সংগঠকদের কাছ থেকে জানা গেল, পাঠাগারটিতে আড়াই শতাধিক সদস্য রয়েছেন। বেশির ভাগের বয়স ১৯ থেকে ২০ বছর। সদস্যরা মাসে ২০ টাকা করে চাঁদা দেন। পাঠাগারে চার হাজারের মতো বই রয়েছে। সদস্যের বাইরে সবার জন্য পাঠাগারে পড়া ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বই বাড়িতে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন পাঠক পাঠাগারে আসেন।
একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক রাফসানুল এহসান সাজ্জাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ রুমির নামে পাঠাগার দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য, যাতে তাঁর মতো ব্যক্তিস্বার্থ না দেখে সামাজিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া শেখে সদস্য-পাঠকেরা। আমরা এই পাঠাগার তৈরির মাধ্যমে দেখিয়েছি, একদল মানুষকে স্বপ্ন দেখানো সম্ভব। এটা কবির কল্পনা নয় বা রূপকথার গল্প নয়। আমরা একদল কিশোর-তরুণ তৈরি করেছি, যারা অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়ায়।’
রাফসানুল প্রতি বুধবার পাঠাগারে গিয়ে পাঠচক্র চালু রাখেন। আগে পাঠাগারের আরও দুটি ভাড়া কক্ষ ছিল। সেখানে স্কুল থেকে ঝরে পড়া ছেলেমেয়ে ও বয়স্ক মানুষদের বিনা মূল্যে লেখাপড়া শেখানো হতো। অর্থের জোগান না থাকায় সেটি বন্ধ রয়েছে।
রাফসানুল বলেন, ‘কড়াইলে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের সংস্কৃতির বিপরীতে গিয়ে পাঠাগার নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়ে বলে অনেকে কুকথা বলেন। পাঠাগারে ছেলেমেয়েদের না পাঠাতে একদল প্রচার করে। এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রশাসনের সহায়তা দরকার।’ তিনি আরও বলেন, বই পড়ার প্রতি মানুষের এমনিতেই আগ্রহ কম। বই পড়ার জন্য ছেলেমেয়েদের একরকম জোরই করতে হয়।
রাফসানুল মনে করেন, বই পড়ার সংস্কৃতি তৈরি করতে পরিবর্তনকামী ও প্রগতিশীল মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সত্যিকারের পরিবর্তন রাষ্ট্রই করতে পারে। তাই সরকারকে বেশিসংখ্যক পাঠাগার কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। কারণ, পাঠাগারে নিয়মিত আসা ছেলেমেয়েদের অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতাও কম থাকে। তারা নিজেরা যেমন স্বপ্ন দেখতে পারে, অন্যকেও স্বপ্ন দেখাতে পারে।