ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন ক্যাম্পাস
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন ক্যাম্পাস

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন ক্যাম্পাস

একটি পরিবেশবান্ধব আধুনিক ইনার সিটি ক্যাম্পাস

কোথাও চলছে ক্লাস। কেউ ব্যস্ত লাইব্রেরিতে। কোথাও চলছে সেমিনার-ওয়ার্কশপ-সিম্পোজিয়াম। অনেকে ল্যাবে ব্যস্ত হাতে-কলমে শিখতে। কারও ব্যস্ততা কুইজ-প্রেজেন্টেশন নিয়ে। কেউবা মুগ্ধ প্রকৃতির স্নিগ্ধতায়। সবুজ ঘাসে প্রাণ খুঁজে চলছেন কেউ কেউ। একই সঙ্গে থেমে নেই আড্ডা আর খুনসুটি। ক্লাসরুম, করিডর, ক্যাফেটেরিয়া কিংবা রুফটপ—ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন ক্যাম্পাসটা যেন জ্ঞানার্জনের এক মহাসমুদ্র।

ঠিক এমনই একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, যেখানে প্রকৃতি ও আধুনিক স্থাপত্যের মিশেলে শিক্ষা আর মুক্তবুদ্ধিচর্চার পরিবেশ তৈরি হবে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির এই পরিবেশবান্ধব ইনার সিটি ক্যাম্পাসের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে স্যার ফজলে হাসান আবেদের শিক্ষাদর্শন এবং ভাবনার প্রতিফলন। তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষা, গবেষণা ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এমন একটা ক্যাম্পাস বানাতে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির এই ক্যাম্পাস স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্নের একটি বাস্তবায়ন।

রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় সাত একর জায়গায় বিস্তৃত ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন এই ক্যাম্পাস বাংলাদেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব ও টেকসই ইনার সিটি ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসটি প্রকৃতি ও স্থাপত্যের মিশেলে নির্মিত হয়েছে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির এই ভবন ডিজাইন, নির্মাণ, পরিবেশ সচেতনতা বিষয় বিভিন্ন ফিচারে সিঙ্গাপুর, চীন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের সেরা বিশেষজ্ঞরা কাজ করেছেন।

নতুন ক্যাম্পাসের এই ভবনে ক্রস ভেন্টিলেশন এবং হাইব্রিড থার্মাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় ভবনটির সবদিক থেকেই আলো ও বাতাস প্রবেশ করতে পারে। অ্যারো ডায়নামিক ফিন ভবনের ভেতরে বাতাসের সর্বোচ্চ প্রবাহ নিশ্চিত করছে। ভবনের গায়ে সবুজ চাদরের মতো লেগে থাকা গাছগুলো অক্সিজেন সরবরাহ করছে এবং হাইব্রিড কুলিং সিস্টেম ক্লাসের ভেতর বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে আসছে, যার ফলে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় ধরে ক্লাসে বসে থাকলেও তাদের ক্লান্তি আসবে না। এসবের ফলে এয়ার কন্ডিশনিংয়ের নির্ভরতা কমে আসে, যা এই ভবনের ৪০ শতাংশ এনার্জি সাশ্রয় করছে।

অত্যাধুনিক এই ভবনের কুলিং সিস্টেমটা বেশ অভিনব। স্বাভাবিক সময়ে এখানে জানালা খুলে ভেন্টিলেশন হয়। আর বেশি গরমের সময় এখানে এয়ার কন্ডিশনকে স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে কয়েক ডিগ্রি তাপমাত্রায় চালানো হয়। এরপর ফ্যান চালালে সেটা কক্ষের তাপমাত্রাকে কয়েক ডিগ্রি নিচে নামিয়ে আনে, যার ফলে আরাম অনুভূত হয়। এই ভবনের বহির্ভাগটা তাপমাত্রা এবং শব্দ প্রতিরোধী করার জন্য জানালায় একাধিক স্তরের শক্তিশালী, পুরু ও স্থিতিস্থাপক অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমে গ্লেজিং করা হয়েছে। তাই অধিক গরমের সময়ও শিক্ষার্থীরা ঠান্ডা অনুভব করেন।

সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে একটি স্বচ্ছ জলাধারের ওপর একাডেমিয়ার কার্যক্রম চলবে। এখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই ভবনের বাইরে বায়োটোপ বা বায়োলজিক্যাল পুল রয়েছে। বৃষ্টির পানি এখানে জমা হয় এবং সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই পানি পরিশোধনের মাধ্যমে ভবনের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

বৃষ্টির পানি জলাধার পর্যন্ত যাতে পৌঁছাতে পারে, সে জন্য অসংখ্য রেইন চেইন বসানো হয়েছে। এই পানি দিয়েই ভবনের গাছপালাগুলোয় সেচ প্রদানের কাজ চলছে এবং বাড়তি পানি জলাধার পূরণে কাজে লাগছে। এই ভবনে রয়েছে অ্যাডভান্সড সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। এই প্ল্যান্টেই হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ভবনের ছাদে রয়েছে ১ দশমিক ৫ মেগাওয়াট পরিমাণে বিদ্যুৎশক্তিসম্পন্ন সোলার প্যানেল, যা এই ভবনের প্রয়োজনীয় শক্তির ২৫ শতাংশ। অত্যাধুনিক ও নান্দনিক এই ভবনের বেশির ভাগ জায়গা শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, যেখানে তাঁরা পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া এবং এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ করতে পারছেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা যেন সহজে ক্যাম্পাসে আসতে পারেন এবং সব জায়গায় বিচরণ করতে পারেন, সে জন্য রয়েছে ইউনিভার্সাল অ্যাকসিবিলিটি। শিক্ষার্থীদের সময় সাশ্রয়ের জন্য রয়েছে লিফট ও এস্কেলেটর।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন ক্যাম্পাস

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৮৪ হাজার দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। ক্যাম্পাসের সবুজায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য এসব গাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, সাভারে অবস্থিত এর রেসিডেন্সিয়াল সেমিস্টার। শিক্ষার্থীদের সহানুভূতিশীল ও দায়িত্ববান মানুষে পরিণত করতে এবং তাঁদের জীবনমুখী ও প্রায়োগিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে নেতৃত্বসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়। এখানে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের একটি সেমিস্টার সম্পন্ন করতে হয়। এখানে ‘অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষার’ নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি সামগ্রিক পাঠ্যক্রম অফার করা হয়ে থাকে, যা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজে জোর দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা মানবিক গুণসম্পন্ন এবং পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারেন।

কম্পিউটার সায়েন্স, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইকোনমিকস, ফার্মেসি, আর্কিটেকচার, এলএলবি, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োটেকনোলজি, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, পাবলিক হেলথসহ যুগোপযোগী অনেক প্রোগ্রাম রয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। এখানে কয়েক ক্যাটাগরিতে স্কলারশিপ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন ক্যাটাগরির স্কলারশিপ। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে ৩৬টি স্টুডেন্ট ক্লাব, যেখানে শিক্ষার্থীরা দক্ষতা অর্জনের বিভিন্ন সুযোগ পেয়ে থাকে। পাশাপাশি দলগত সহযোগিতার মাধ্যম কাজ করতে শেখার মাধ্যমে অর্জন করে নেতৃত্বগুণ।

শিক্ষা ও গবেষণায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২৩ সালের টাইমস হায়ার এডুকেশন ইউনিভার্সিটি ইমপ্যাক্ট র‍্যাঙ্কিংয়ে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ অর্জনে বিশ্বের সেরা পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি দেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণাক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছে।

উন্নত গবেষণার জন্য ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসসহ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অনেক প্রতিষ্ঠান এখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রখ্যাত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনামের সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে।

শিক্ষা উন্নয়নের বহুবিধ অর্জনে বিখ্যাত ‘ইদান’ পুরস্কার লাভ করেছে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট। জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ স্বীকৃত জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ এই অঞ্চলের সেরা একটি স্কুলে পরিণত হয়েছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্প্রতি বিশ্বসেরা ১০০ থিঙ্কট্যাংকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে শান্তি প্রচার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজুড়ে কদর রয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের। এ ছাড়া বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকা বণ্টনের কৌশল নিয়ে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ২০২৪ সালের ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর স্মল বিজনেস (আইসিএসবি) ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে গ্লোবাল ইমপ্যাক্ট অ্যাওয়ার্ড জিতেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিইডি)।

বিশ্বের ২৫০ টির বেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমসংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির। ২০২০ সালে ‘ওপেন সোসাইটি ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্ক’ প্রথম বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যোগ দিয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। ওপেন সোসাইটি ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্ক হলো বিশ্বজুড়ে শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন দ্বারা একত্র হওয়া বৈশ্বিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি জোট। সেই সঙ্গে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্ক’–এর মতো বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়ে চলেছে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বিশ্বের ২৪টি দেশের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে গড়ে উঠেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ বহুসংস্কৃতিময় এক স্টুডেন্ট কমিউনিটি।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সাফল্য ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বে। প্রথম বাংলাদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৭ সালে ‘ব্র্যাক অন্বেষা’ নামক নিজস্ব ন্যানো স্যাটেলাইট তৈরি করেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। গোটা দেশের জন্যই এটি একটি অনন্য অর্জন। ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ ২০২০ (ইউআরসি) প্রতিযোগিতায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পরবর্তী প্রজন্মের রোভার ‘মঙ্গলতরী’ বৈশ্বিকভাবে তৃতীয় স্থান লাভ করেছে, যেখানে প্রথম স্থানে ছিল ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান ও রানারআপ হয় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি। ২০২৪ সালের প্রতিযোগিতায় ফাইনালে জায়গা করে নেয় ‘মঙ্গলতরী ফনিক্স’।

২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি দল হিসেবে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকেরা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ওয়ার্ল্ড ডিবেট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। সেই সঙ্গে ২০২১ সালে কেমব্রিজ ইউনিয়ন আয়োজিত বিশ্বের আরেকটি মর্যাদাপূর্ণ বিতর্ক প্রতিযোগিতা কেমব্রিজ ইন্টারভার্সিটি জিতে নেয় দলটি। শিক্ষার্থীদের ক্রিটিক্যাল স্কিল তৈরিতে অবদান রাখায় ২০২২ সালে টানা তৃতীয়বারের মতো ‘আইইইই রিজওনাল এক্সেমপ্লারি স্টুডেন্ট ব্রাঞ্চ অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। এসব অর্জন দেশে-বিদেশে দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি আধুনিক মেডিকেল সেন্টার, দক্ষ কাউন্সেলিং সেন্টার, নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থা ও ক্যারিয়ার সার্ভিসের মতো অব্যাহত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্টুডেন্ট লাইফ এক্সপেরিয়েন্সকে আরও উন্নততর করেছে। ডে–কেয়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধার মাধ্যমে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি হয়ে উঠেছে একটি কর্মিবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়।

নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি, মানবিক মূল্যবোধের সমর্থন এবং টেকসই উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ২০০১ সালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ গড়ে তোলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। এটির নতুন ক্যাম্পাস নগরায়ণের মধ্যেও প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রেখে পৃথিবীকে আরও বেশি বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবার জন্য একটি ‘পয়েন্ট অব রেফারেন্স’ হয়ে থাকবে।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন ক্যাম্পাস

অত্যাধুনিক এই ভবনের কুলিং সিস্টেমটা বেশ অভিনব। স্বাভাবিক সময়ে এখানে জানালা খুলে ভেন্টিলেশন হয়। আর বেশি গরমের সময় এখানে এয়ার কন্ডিশনকে স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে কয়েক ডিগ্রি তাপমাত্রায় চালানো হয়। এরপর ফ্যান চালালে সেটা কক্ষের তাপমাত্রাকে কয়েক ডিগ্রি নিচে নামিয়ে আনে, যার ফলে আরাম অনুভূত হয়। এই ভবনের বহির্ভাগটা তাপমাত্রা এবং শব্দ প্রতিরোধী করার জন্য জানালায় একাধিক স্তরের শক্তিশালী, পুরু ও স্থিতিস্থাপক অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমে গ্লেজিং করা হয়েছে। তাই অধিক গরমের সময়ও শিক্ষার্থীরা ঠান্ডা অনুভব করেন।

সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে একটি স্বচ্ছ জলাধারের ওপর একাডেমিয়ার কার্যক্রম চলবে। এখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই ভবনের বাইরে বায়োটোপ বা বায়োলজিক্যাল পুল রয়েছে। বৃষ্টির পানি এখানে জমা হয় এবং সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই পানি পরিশোধনের মাধ্যমে ভবনের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

বৃষ্টির পানি জলাধার পর্যন্ত যাতে পৌঁছাতে পারে, সে জন্য অসংখ্য রেইন চেইন বসানো হয়েছে। এই পানি দিয়েই ভবনের গাছপালাগুলোয় সেচ প্রদানের কাজ চলছে এবং বাড়তি পানি জলাধার পূরণে কাজে লাগছে। এই ভবনে রয়েছে অ্যাডভান্সড সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। এই প্ল্যান্টেই হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

ভবনের ছাদে রয়েছে ১ দশমিক ৫ মেগাওয়াট পরিমাণে বিদ্যুৎশক্তিসম্পন্ন সোলার প্যানেল, যা এই ভবনের প্রয়োজনীয় শক্তির ২৫ শতাংশ। অত্যাধুনিক ও নান্দনিক এই ভবনের বেশির ভাগ জায়গা শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, যেখানে তাঁরা পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া এবং এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ করতে পারছেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা যেন সহজে ক্যাম্পাসে আসতে পারেন এবং সব জায়গায় বিচরণ করতে পারেন, সে জন্য রয়েছে ইউনিভার্সাল অ্যাকসিবিলিটি। শিক্ষার্থীদের সময় সাশ্রয়ের জন্য রয়েছে লিফট ও এস্কেলেটর।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৮৪ হাজার দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে।

ক্যাম্পাসের সবুজায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য এসব গাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, সাভারে অবস্থিত এর রেসিডেন্সিয়াল সেমিস্টার।

শিক্ষার্থীদের সহানুভূতিশীল ও দায়িত্ববান মানুষে পরিণত করতে এবং তাঁদের জীবনমুখী ও প্রায়োগিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে নেতৃত্বসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়। এখানে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের একটি সেমিস্টার সম্পন্ন করতে হয়। এখানে ‘অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষার’ নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি সামগ্রিক পাঠ্যক্রম অফার করা হয়ে থাকে, যা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজে জোর দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা মানবিক গুণসম্পন্ন এবং পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে পারেন।

কম্পিউটার সায়েন্স, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইকোনমিকস, ফার্মেসি, আর্কিটেকচার, এলএলবি, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োটেকনোলজি, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, পাবলিক হেলথসহ যুগোপযোগী অনেক প্রোগ্রাম রয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। এখানে কয়েক ক্যাটাগরিতে ১০ থেকে ১০০ পর্যন্ত স্কলারশিপ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন ক্যাটাগরির স্কলারশিপ। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে ৩৬টি স্টুডেন্ট ক্লাব, যেখানে শিক্ষার্থীরা দক্ষতা অর্জনের বিভিন্ন সুযোগ পেয়ে থাকে। পাশাপাশি দলগত সহযোগিতার মাধ্যম কাজ করতে শেখার মাধ্যমে অর্জন করে নেতৃত্বগুণ।

শিক্ষা ও গবেষণায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়।

২০২৩ সালের টাইমস হায়ার এডুকেশন ইউনিভার্সিটি ইমপ্যাক্ট র‍্যাঙ্কিংয়ে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ অর্জনে বিশ্বের সেরা পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি দেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণাক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেছে।

উন্নত গবেষণার জন্য ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসসহ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অনেক প্রতিষ্ঠান এখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রখ্যাত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনামের সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে।

শিক্ষা উন্নয়নের বহুবিধ অর্জনে বিখ্যাত ‘ইদান’ পুরস্কার লাভ করেছে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট। জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ স্বীকৃত জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ এই অঞ্চলের সেরা একটি স্কুলে পরিণত হয়েছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্প্রতি বিশ্বসেরা ১০০ থিঙ্কট্যাংকের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে শান্তি প্রচার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজুড়ে কদর রয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের। এ ছাড়া বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকা বণ্টনের কৌশল নিয়ে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ২০২৪ সালের ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর স্মল বিজনেস (আইসিএসবি) ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে গ্লোবাল ইমপ্যাক্ট অ্যাওয়ার্ড জিতেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিইডি)।

বিশ্বের ২৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমসংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির।

২০২০ সালে ‘ওপেন সোসাইটি ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্ক’ প্রথম বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যোগ দিয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। ওপেন সোসাইটি ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্ক হলো বিশ্বজুড়ে শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন দ্বারা একত্র হওয়া বৈশ্বিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি জোট। সেই সঙ্গে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্ক’–এর মতো বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়ে চলেছে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা।

বিশ্বের ২৪টি দেশের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে গড়ে উঠেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ বহুসংস্কৃতিময় এক স্টুডেন্ট কমিউনিটি।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সাফল্য ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বিশ্বে। প্রথম বাংলাদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৭ সালে ‘ব্র্যাক অন্বেষা’ নামক নিজস্ব ন্যানো স্যাটেলাইট তৈরি করেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।

গোটা দেশের জন্যই এটি একটি অনন্য অর্জন। ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ ২০২০ (ইউআরসি) প্রতিযোগিতায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পরবর্তী প্রজন্মের রোভার ‘মঙ্গলতরী’ বৈশ্বিকভাবে তৃতীয় স্থান লাভ করেছে, যেখানে প্রথম স্থানে ছিল ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান ও রানারআপ হয় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি। ২০২৪ সালের প্রতিযোগিতায় ফাইনালে জায়গা করে নেয় ‘মঙ্গলতরী ফনিক্স’।

২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি দল হিসেবে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকেরা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ওয়ার্ল্ড ডিবেট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। সেই সঙ্গে ২০২১ সালে কেমব্রিজ ইউনিয়ন আয়োজিত বিশ্বের আরেকটি মর্যাদাপূর্ণ বিতর্ক প্রতিযোগিতা কেমব্রিজ ইন্টারভার্সিটি জিতে নেয় দলটি। শিক্ষার্থীদের ক্রিটিক্যাল স্কিল তৈরিতে অবদান রাখায় ২০২২ সালে টানা তৃতীয়বারের মতো ‘আইইইই রিজওনাল এক্সেমপ্লারি স্টুডেন্ট ব্রাঞ্চ অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। এসব অর্জন দেশে-বিদেশে দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি আধুনিক মেডিকেল সেন্টার, দক্ষ কাউন্সেলিং সেন্টার, নিজস্ব পরিবহনব্যবস্থা ও ক্যারিয়ার সার্ভিসের মতো অব্যাহত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্টুডেন্ট লাইফ এক্সপেরিয়েন্সকে আরও উন্নততর করেছে। ডে–কেয়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধার মাধ্যমে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি হয়ে উঠেছে একটি কর্মিবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়।

নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি, মানবিক মূল্যবোধের সমর্থন এবং টেকসই উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ২০০১ সালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ গড়ে তোলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। এটির নতুন ক্যাম্পাস নগরায়ণের মধ্যেও প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রেখে পৃথিবীকে আরও বেশি বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবার জন্য একটি ‘পয়েন্ট অব রেফারেন্স’ হয়ে থাকবে।