ঈদুল আজহার আগে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া মুশফিকুর রহমান (ইফাত) নামের সেই তরুণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানেরই ছেলে। তাঁর একাধিক নিকটাত্মীয় ও জনপ্রতিনিধি গতকাল বৃহস্পতিবার নিশ্চিত করেছেন, ইফাত মতিউর রহমানের দ্বিতীয় সংসারের প্রথম সন্তান।
যদিও মতিউর রহমানের দাবি, ইফাত তাঁর ছেলে নয়। এ বিষয়ে পরিবারটির ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার কারণে মতিউর রহমান ছেলেকে অস্বীকার করছেন। কারণ, ১৫ লাখের ছাগলকে কেন্দ্র করে ভাইরাল হওয়ার পর ইফাতের দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবনযাপনের নানা বিবরণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। সরকারি চাকরজীবী বাবার বেতনের টাকা দিয়ে ছেলে কীভাবে এমন ব্যয়বহুল জীবনযাপন করতে পারে, তা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ছেলের পরিচয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
অবশ্য ফেসবুকে বিতর্কের মুখে ওই ছাগল ইফাত আর বাসায় নেননি দাবি করেছে ছাগলটির মালিক সাদিক অ্যাগ্রো কর্তৃপক্ষ। তবে ইফাত আরও বেশি দামে একাধিক গরু কিনেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে। যদিও সে তথ্য নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে ছেলের ছাগল–কাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু আলোচনা এখন মতিউর রহমানের সম্পদের দিকে গড়িয়েছে। তাঁর কত সম্পদ রয়েছে, সেটি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নরসিংদীতে তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের নামে অনেক সম্পত্তি রয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে লিখছেন। এর মধ্যে শেয়ারবাজারে তাঁর বিপুল বিনিয়োগের খবরও বের হয়েছে। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হলেও শেয়ারবাজারে প্লেসমেন্ট শেয়ারের বড় ব্যবসায়ী। তিনি নিজেও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভিতে (১৯ জুন প্রচারিত) এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি বিভিন্ন কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ওই কোম্পানির মালিকদের কাছ থেকে কম দামে কিনে নিয়ে পরে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে অনেক মুনাফা করেছেন।
এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছেন এখন। তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদেও রয়েছেন। তিনি গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এবার ঢাকার বাইরের একটি খামার থেকে কোরবানির পশু কিনেছেন; কিন্তু ছাগল কেনার আলোচনা ছড়িয়ে পড়ায় এবার তাঁর পরিবারের ঈদ মাটি হয়ে গেছে। তিনি দাবি করেন, ১৫ লাখ টাকায় ছাগল কিনতে যাওয়া ইফাত তাঁর সন্তান নয়।
তবে মতিউর রহমানের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ইফাত যে তাঁরই সন্তান, সেটির সপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেকগুলো ছবি ও তথ্য বিভিন্নজন প্রকাশ করতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সাইয়েদ আবদুল্লাহ তাঁর এক ফেসবুক পোস্টে এ–সংক্রান্ত কিছু তথ্য উপাত্ত তাঁর পোস্টে যুক্ত করেছেন।
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইফাতের মা শাম্মী আখতার শিভলী ওরফে শিবু মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী। শাম্মী আখতারের বাবার বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। শাম্মী আখতার ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য (ফেনী-২) নিজাম উদ্দিন হাজারীর আত্মীয়।
নিজাম উদ্দিন হাজারী গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ লাখ টাকার ছাগল কেনার ইস্যুতে আলোচনায় আসা ইফাত তাঁর মামাতো বোন শাম্মী আখতারের (শিবু) ছেলে। শাম্মী আখতার এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী।
মতিউর রহমান বিভিন্ন সময়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ফেনীর সোনাগাজীতে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেছেন বলেও জানিয়েছেন আমিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সোনাগাজী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আজিজুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমান তাঁর চাচাতো বোনের স্বামী। ইফাত তাঁদের সন্তান। শাম্মী আখতারের ভাইয়েরা বিদেশে থাকেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল বৃহস্পতিবার আবার এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি মুঠোফোনে কল ও খুদে বার্তার কোনোটিতেই সাড়া দেননি।
এদিকে মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাতের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। ‘এএক্স আবিদ’ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্টটিতে দাবি করা হয়, ইফাতের হাতের আইফোনটি তিনি দিয়েছেন। তাঁর দুই আপন মামার একজন দুবাইয়ে শতকোটি টাকার মালিক। আমেরিকায় থাকা আরেক মামাও শিল্পপতি। ইফাত শিল্পপতি মামার জন্যই ছাগলটি কিনেছিল। তাই না বুঝে কারও ক্ষতি না করাই ভালো।
এএক্স আবিদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি ইফাতের নিকটাত্মীয়। তাঁর প্রকৃত নাম আবিদুল ইসলাম। তিনি ফেনী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়লা জেসমিনের (বড়মনি) ছেলে। এই আবিদ ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। আবিদও ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর আত্মীয়।
জানা যায়, মতিউর রহমানের বাড়ি বরিশালের মুলাদি উপজেলায়। তাঁর প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ নরসিংদীর রায়পুরা থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান। এই সংসারে তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
প্রথম আলোর নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, ছাগল–কাণ্ডের ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর লায়লা কানিজ আর উপজেলা পরিষদে যাননি। গতকাল তাঁর তিনটি মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে দুটি ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। অপর নম্বরে রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
মতিউর রহমান সম্পর্কে জানতে চাইলে এনবিআরের একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, ১১তম বিসিএসে বাণিজ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন মতিউর রহমান। পরে এই ক্যাডারের সাত কর্মকর্তাকে কাস্টমস ক্যাডারে একীভূত করা হয়। মতিউর রহমানও তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর ছেলের বিষয়টি সামনে আসার পর থেকে সহকর্মীরাও অস্বস্তিতে পড়েছেন।
গতকাল ঢাকার এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের কাছে মতিউর রহমানের বিষয়ে জানতে চান সাংবাদিকেরা। তখন এনবিআরের চেয়ারম্যান প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘এটা কোনো প্রশ্ন নয়। এ নিয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না।’
[প্রতিবেদন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রথম আলোর ফেনী প্রতিনিধি ও সোনাগাজী প্রতিনিধি]