আয় থাকলেও কাজে নেই

জেলা পরিষদগুলোর আয় ও বরাদ্দ ভালো। বিস্তৃত কাজের সুযোগ থাকলেও সেগুলো করেন না পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা।

খুলনা জেলা পরিষদ গত পাঁচ বছরে স্কুল–কলেজের শিক্ষকদের জন্য কোনো প্রশিক্ষণের আয়োজন করেনি। স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য দুধ ও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহে তাদের কোনো উদ্যোগও ছিল না। দরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য ছিল না কোনো আইনি সহায়তা। বনভূমি সংরক্ষণেও কোনো ভূমিকা ছিল না। অথচ আইন অনুযায়ী এসব কাজের সব কটিই জেলা পরিষদের করার কথা।

আইন অনুযায়ী এমন ১২টি বাধ্যতামূলক ও ৬৮ ধরনের ঐচ্ছিক কাজ করার কথা স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের প্রতিষ্ঠান জেলা পরিষদের। কিন্তু সেসব কাজে তেমন মনোযোগ নেই তাদের। সম্পদ ইজারা দিয়ে টাকা আদায় আর ছোট আকারের প্রকল্প বাস্তবায়নেই সীমাবদ্ধ থাকছে পরিষদের কার্যক্রম। জেলার সার্বিক উন্নয়নকাজ তদারক করার কথা জেলা পরিষদের, সেটাও করা হয় না।

অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বিবেচনায় জেলা পরিষদগুলোর আয় ও বরাদ্দ ভালো। যেমন খুলনা জেলা পরিষদের বছরে গড়ে নিজস্ব আয় ৪০ কোটি টাকা, সরকারি বরাদ্দ থাকে ৬ কোটি টাকার বেশি। পিরোজপুর জেলা পরিষদের আয় হয়েছে ১৩ কোটি টাকার বেশি। বরাদ্দ কমবেশি আট কোটি টাকা।

আয় ও বরাদ্দের কারণে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য হতে আগ্রহী ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জেলা পরিষদ সদস্য হন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

পরিষদের সদস্যপদকে ‘লাভজনক’ ধরেই তাঁরা নির্বাচনে আগ্রহী হন। এবার পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলা পরিষদ (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) বাদে বাকি ৬১ জেলা পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও সদস্যপদে ২ হাজার ৮৬০ জন প্রার্থী হয়েছেন। আগামী ১৭ অক্টোবর জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট। এর মধ্যে ১৯ জেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

নিজস্ব আয় ও সরকারি বরাদ্দ কত

প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, জেলা পরিষদগুলোর বছরে আয় ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি টাকা পর্যন্ত। আর সরকারি বরাদ্দ থাকে ৫ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে খুলনা, ময়মনসিংহ, শরীয়তপুর, পিরোজপুর ও জয়পুরহাট জেলা পরিষদের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিটি জেলা পরিষদেরই নিজস্ব সম্পদ ও জমি রয়েছে। জেলায় জমি কেনাবেচা থেকে যত রাজস্ব আসে, তার ১ শতাংশ অর্থ জেলা পরিষদ পায়। খেয়াঘাট, মার্কেটের দোকান, জমি ও পুকুর ইজারা, ডাকবাংলো ও মিলনায়তনের ভাড়া তো রয়েছেই। বিভিন্ন ব্যাংকে জেলা পরিষদগুলোর স্থায়ী আমানতও রয়েছে।

খুলনা জেলা পরিষদ বছরে গড়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা আয় করে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে বছরে ছয় কোটি টাকার মতো বরাদ্দ পায়। জেলা পরিষদের আগে থেকে সাড়ে ৯ কোটি টাকার একটি স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ছিল। গত দুই অর্থবছরে রাজস্ব উদ্বৃত্ত থেকে আরও ১০ কোটি টাকার এফডিআর করা হয়েছে। বর্তমানে সাড়ে ১৯ কোটি টাকার এফডিআর আছে। খুলনা জেলা পরিষদ ১৪টি খেয়াঘাট ও ৪টি মার্কেটের ১২৪টি দোকান ও জমি ইজারা থেকে মোটা অঙ্কের আয় করে।

এমন আয়ের পরও খুলনা জেলা পরিষদের নির্ধারিত কাজের পরিমাণ সীমিত। এ বিষয়ে পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আছাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী অনেক ধরনের কাজই করা যায়নি। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পিরোজপুর জেলা পরিষদের বছরে আয় কমবেশি সাড়ে ১৩ কোটি টাকা। সরকারের বরাদ্দ থাকে আট কোটি টাকার মতো। গত ৫ বছরে জেলা পরিষদ সরকারি অনুদান পেয়েছে প্রায় ৪১ কোটি টাকা। জেলা পরিষদের ৬৮০ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে বেদখলে আছে প্রায় ২৬ একর জমি। বেদখল জমি উদ্ধারে আদালতে মামলা চলমান।

শরীয়তপুর জেলা পরিষদের প্রতিবছর গড় আয় ৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর সরকারি বরাদ্দ থাকে পাঁচ কোটি টাকা। গত ৫ বছরে জেলা পরিষদে সরকারি অনুদান পেয়েছে ২৫ কোটি টাকা। জেলা পরিষদের সম্পদের মধ্যে রয়েছে ৬টি ডাকবাংলো, ১৫০ একর জমি, ১টি মিলনায়তন, ২৮টি ছোট–বড় পুকুর।

ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের আয় বছরে গড়ে ২০ কোটি টাকা। সরকারি অনুদান গড়ে ১০ কোটি টাকা। পরিষদ সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর বিভিন্ন খাতে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা মূল্যমানের প্রায় ৬০০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এসব প্রকল্পের নাম প্রস্তাব করেন জেলা পরিষদ সদস্যরা।

স্থানীয় সরকার বিভাগের জেলা পরিষদ শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এডিপি থেকে জেলা পরিষদ উন্নয়ন সহায়তা খাতে সাধারণ বরাদ্দ রয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। গত ৮ আগস্ট এই বরাদ্দের প্রথম কিস্তির ৫৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা জেলা পরিষদগুলোকে দেওয়া হয়েছে।

নির্ধারিত কাজ করেন না চেয়ারম্যান-সদস্যরা

আইন অনুযায়ী, জেলা পরিষদের বাধ্যতামূলক কাজের মধ্যে রয়েছে জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা; উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার গৃহীত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা; জনসাধারণের ব্যবহারে উদ্যান, সড়ক ও কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণ, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ। এ ছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, জনস্বাস্থ্য, গণপূর্ত, অর্থনৈতিক কল্যাণসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঐচ্ছিক কাজও করবে তারা।

সর্বশেষ নির্বাচিত জেলা পরিষদের ১০ জন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। তাঁরা বলেছেন, জেলা পরিষদের যেসব কাজ করার কথা, সেগুলো করা হয় না।

সদস্যরা শুধু ছোট আকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও শ্মশানের তালিকা প্রণয়নের কাজ করেন। এই তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে উপজেলা পরিষদের সঙ্গে জেলা পরিষদ সদস্যদের কোনো সমন্বয় থাকে না।

ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের দুজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের নাম দেওয়া ছাড়া জেলা পরিষদের সদস্যদের কাজ থাকে না। উপজেলার কাজ তদারক করতে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিই নেই। তাঁরা উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সদস্যও নন। ফলে সমন্বয় সভায় কী আলোচনা হয়, কী সিদ্ধান্ত হয়, কিছুই জানেন না তাঁরা।

জেলা পরিষদের কাজের বিস্তৃত সুযোগ থাকলেও চেয়ারম্যান ও সদস্যরা তা করতে আগ্রহী নন বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, জেলা পরিষদ দুই লাখ টাকার কম মূল্যের প্রকল্পে অনুদান দিতে ব্যস্ত।

অস্তিত্ব নেই, এমন প্রকল্পেও এসব বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা থেকে বের হতে হবে। তাঁর মতে, জেলা পরিষদগুলোর বছরে পাঁচটির বেশি প্রকল্প নেওয়া উচিত নয়।

 [প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক প্রতিনিধিরা]