তুরস্কের এক নাগরিক গত ৭ জুন বাংলাদেশে আসেন। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ম মেনে তাঁকেও স্ক্রিনিং করা হয়। তাঁর শরীরে কিছু ফুসকুড়ি দেখা দেওয়ায় তৎক্ষণাৎ পাঠানো হয় হাসপাতালে। শরীরে ফুসকুড়ি মাঙ্কিপক্সের অন্যতম লক্ষণ। পরে অবশ্য দেখা যায়, তাঁর শরীরে মাঙ্কিপক্সের কোনো উপসর্গ নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) আহমেদুল কবীর পরদিন বলেন, ‘তাঁর (তুরস্কের নাগরিক) মাঙ্কিপক্সের কোনো উপসর্গ নেই। তাঁর শরীরে যে ফুসকুড়ি, তা দীর্ঘদিনের চর্মরোগের কারণে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাঙ্কিপক্স ছড়ানোর পর বাংলাদেশে তুরস্কের নাগরিকের ওই ঘটনায় জোর আলোচনা শুরু হয়। যদিও পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়। এর আগে মে মাসের শেষের দিকে দেশের বন্দরগুলোয় সতর্কতা জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরই মধ্যে গতকাল শনিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাঙ্কিপক্স সংক্রমণকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি সতর্কতা ঘোষণা করে। গতকাল ডব্লিউএইচওর জরুরি কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক শেষে এ ঘোষণা দেন সংস্থাটির প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস।
বৈশ্বিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি সতর্কতা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বোচ্চ সতর্কতা। এখন পর্যন্ত ৭৫টি দেশে ১৬ হাজারের বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে গতকাল জানিয়েছেন ডব্লিউএইচওর প্রধান। তিনি বলেন, ‘মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণকে বৈশ্বিক জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। এটি সারা বিশ্বের জন্য উদ্বেগের।’
তবে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, ভাইরাস বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলে আসছেন, এ নিয়ে বাংলাদেশে খুব বেশি ভয়ের কারণ নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংক্রামক রোগ) অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ডব্লিউএইচও–র বার্তা পেয়েছি। আমরা শুরু থেকেই সতর্ক। তবে কাউকে অকারণ ভীতির মধ্যে ফেলতে চাই না। কিন্তু আমরা সতর্ক আছি। আজও এ নিয়ে আমরা বসব।’
দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্স নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, তবে ভীত হওয়ার কারণ নেই। কারণ, বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিতে। এর পেছনে তিনটি কারণের কথা তুলে ধরেছেন তাঁরা।
মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের পেছনে রয়েছে মাঙ্কিপক্স নামের ভাইরাস। এটি স্মলপক্স ভাইরাস শ্রেণির। করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই উত্তর আমেরিকা, ইউরোপসহ বেশ কয়েকটি দেশে মাঙ্কিপক্সের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী শনাক্ত হয়েছে। স্মলপক্স নির্মূলের শেষ পর্যায়ে এসে ১৯৭০-এর দিকে কঙ্গোতে মানব শরীরে এর প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে। ১৯৫৮ সালে বানরের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর এটি মাঙ্কিপক্স হিসেবে পরিচিতি পায়। একে মাঙ্কিপক্স বলা হলেও এটি মূলত ইঁদুর বা কাঠবিড়ালিজাতীয় প্রাণীর মাধ্যমে ছড়ায়। বানর কিন্তু এর বাহক হিসেবে কাজ করে না। এসব প্রাণী যদি আক্রান্ত থাকে, তবে তাদের সংস্পর্শে এলে এটি মানুষে ছড়ায়। মাঙ্কিপক্সের ভাইরাসের দুটি ধরন। কঙ্গোতে যে ভাইরাস পাওয়া যায়, তার মৃত্যুহার ১ থেকে ১০ শতাংশ। কিন্তু পশ্চিম আফ্রিকার ভাইরাসে মৃত্যুহার প্রায় শূন্য বলা চলে।
বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্সের ভীতি অপেক্ষাকৃত কম বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম। এর পেছনে তিনটি কারণ উল্লেখ করেন তিনি। সেগুলো হলো—বাংলাদেশের আগাম সতর্কতা, পুরুষ সমকামী গোষ্ঠীর কম সংখ্যা এবং ভারতে এ রোগের সংখ্যার কম উপস্থিতি।
মাঙ্কিপক্স বিশ্বে ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই মে মাসেই দেশের সব বন্দরে স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা শুরু হয়। এটি এখনো চলছে। তবে এসব কাজে আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা হচ্ছে বলে জানান অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সতর্ক হতে দোষ নেই। আবার অকারণ ভীতিরও দরকার নেই।’
এই সতর্কতা বাংলাদেশের জন্য ভালো ফল এনেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল।
ডব্লিউএইচও–র তথ্য অনুযায়ী, প্রাণী থেকে মানুষে এবং মানুষ থেকে মানুষে মাঙ্কিপক্স ছড়াতে পারে। হাঁচি–কাশির কারণে তৈরি হওয়া ড্রপলেট শরীরে কোনো ক্ষতের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে মাঙ্কিপক্স ছড়াতে পারে। শ্বাসের মাধ্যমে ছড়ানোর জন্য মানুষের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান থাকতে হয়। অর্থাৎ, নিবিড় কোনো সংযোগের মাধ্যমেই ছড়াতে পারে মাঙ্কিপক্স। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত যত জন আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের সবাই পুরুষ এবং সমকামী।
গত বৃহস্পতিবার ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, মাঙ্কিপক্সের সাম্প্রতিক সংক্রমণের ৯৫ শতাংশ ঘটেছে যৌন ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে। মাঙ্কিপক্স-সংক্রান্ত এ ধরনের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় গবেষণা এটি। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল থেকে ২৪ জুনের মধ্যে বিশ্বের ১৬টি দেশে নিশ্চিত সংক্রমিত ৫২৮টি মাঙ্কিপক্সের ঘটনার ওপর গবেষণা করেন। বার্তা সংস্থা এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
গবেষণাপত্রের মুখ্য লেখক জন থর্নহিল এক বিবৃতিতে বলেন, সাধারণ অর্থে মাঙ্কিপক্স যৌনবাহিত সংক্রমণ নয়। কিন্তু তা ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংসর্গের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। প্রধানত পুরুষের সঙ্গে পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে এমনটা হয়েছে।
বাংলাদেশে পুরুষ সমকামীদের উপস্থিতি থাকলেও তাদের বেশির ভাগের সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। পশ্চিমের দেশগুলোর মতো দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক দেশে নগণ্য। আর এর কারণে মাঙ্কিপক্সের ঝুঁকি অনেকটাই কম বলে মনে করেন এই খ্যাতনামা ভাইরাসবিদ।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, সমকামিতা হয়তো একটি কারণ, কিন্তু একমাত্র কারণ নিশ্চয় নয়। বাংলাদেশে সমকামিতার বিষয়টি কম। সেই নিরিখে এটা ঠিক, এখানে এর ঝুঁকি কম। তবে বাংলাদেশে সার্বিকভাবেই এ ভাইরাস নিয়ে ঝুঁকি কম। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এ ভাইরাস সহজে ছড়ায় না। আপনি যদি সরাসরি আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে না আসেন, তবে ভাইরাসটি ছড়ানো মুশকিল।’
বিশ্বের একপ্রান্তে একটি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হলে ছড়াতে সময় লাগে না। করোনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ডেলটা ও অমিক্রন ধরন ভারতের বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও এটি বেড়ে গেছে। ভারতে আজ পর্যন্ত চারজন মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন কেরালায় এবং একজন দিল্লিতে। ভারতের মাঙ্কিপক্সের এই কম আক্রান্তের সংখ্যা আমাদের শঙ্কার কমের একটা কারণ বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। এ প্রসঙ্গে তিনি এইচআইভি-এইডস নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ১৯৯৬ সালে দেশের তিনটি যৌনপল্লিতে এ পরীক্ষা হয়। এর মধ্যে টাঙ্গাইল ও দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে কোনো এইচআইভি পজিটিভ পাওয়া যায়নি। তবে যশোরে দুজন যৌনকর্মী শনাক্ত হন। তাঁদের দুজনেরই কলকাতার সোনাগাছি যৌনপল্লিতে যাওয়ার রেকর্ড ছিল।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতে এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি নয়। পশ্চিমবঙ্গেও কাউকে পাওয়া যায়নি। এসব আমাদের জন্য ভালো খবর। তবে কঠোর পর্যবেক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ, যেসব দেশে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ বেশি, সেসব দেশের সঙ্গে কিন্তু আমাদের যোগাযোগ আছে। তাই সতর্কতার বিকল্প নেই।’