কখনো তিনি ছিনতাইকারী, কখনো মাদকসেবী, বেকার যুবক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, হিজড়া, বাসচালকের সহকারী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, টুকরিতে ঘুমিয়ে থাকা শ্রমিক, আবার কখনো সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া যুবক বা রেললাইনের পাশে পড়ে থাকা কোনো অজ্ঞাত লাশ।
বস্ত্র প্রকৌশলী সাঈদ রিমন ১৫ বছর ধরে এভাবেই সচেতনতা তৈরিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন। এসব চরিত্রের ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করছেন। যেসব চরিত্রে অভিনয় করেন, সেসব চরিত্রের মানুষগুলোর বঞ্চনা, অপরাধ বা দুঃখ–কষ্ট তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি।
৬ নভেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে এসব ছবির প্রসঙ্গেই কথা বলছিলেন বরগুনার ছেলে সাঈদ। শুরুতে এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে তার ভিডিও ফুটেজ এলাকার ডিশলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করতেন। এতে করে অনেকেই তাঁকে ‘পাগল’ ভাবতেন। বিয়ের সময় এসব ফুটেজের বিষয় সামনে আসায় বিড়ম্বনাতেও পড়তে হয়েছিল।
২০০৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় এক প্রতিবেশীর মৃত্যুর ঘটনা নাড়া দিয়েছিল সাঈদকে। সেই থেকে এ ধরনের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার বিষয়টি মাথায় আসে। ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে ভিডিওচিত্র থেকে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরির কাজটি শুরু করেন। এ কাজে তিনি কারও কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নেন না। নিজের আয়ের একটি ছোট অংশ ব্যয় করেন এ কাজে। আর এ বিষয়টিকে সংগঠন আকারে করার পক্ষেও নন তিনি।
সাঈদ বললেন, সংগঠন করে বা কারও কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিলে দেখা যাবে কাজটিই আর হবে না। এর চেয়ে সংসার, চাকরির পাশাপাশি তিনি স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে কাজটি করছেন। চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে হয় বলে একেকটি ছবি তোলার জন্য সময় একটু বেশিই লাগে।
গত কয়েক বছরে অপরাধের ধরন পাল্টেছে। নানা সামাজিক ইস্যু সামনে এসেছে। তাই সাঈদের ছবির সংখ্যাও বেড়েছে। ফেসবুকে এ পর্যন্ত পোস্ট করেছেন প্রায় ৭০০ ছবি। ৩৪ বছর বয়সী সাঈদ যেভাবে সচেতনতা তৈরির কাজ করছেন, তা তাঁর একক লড়াই বলে উল্লেখ করলেন তিনি।
আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক করেছেন সাঈদ। বর্তমানে রাজধানীতে ওএসএন সোর্সিং কোম্পানিতে সিইও হিসেবে কর্মরত আছেন। বেসরকারি নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
সাঈদ শুধু ফেসবুকে ছবিই পোস্ট করছেন না, লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার বানিয়ে তা বিনা মূল্যে বিলি করছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায়। পুলিশের পক্ষ থেকে বরগুনা, নাটোরসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর কোনো কোনো ছবি বিলবোর্ড ও স্টিকারে জায়গা পেয়েছে।
দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ইন্ডিয়া টুডেসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়েছেন সাঈদ। কিংবদন্তী প্রকাশনী ‘সচেতনতার সহজ পাঠ’ নামে সাঈদের ছবি ও লেখা দিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছে। করোনার সময় থেকে সাঈদ পথে বসবাস করা মানুষদের খাবার দেওয়া শুরু করেছিলেন, তা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন।
সাঈদ জানালেন, এখন বাসযাত্রীদের অনেকেই তাঁকে চিনতে পারেন। ২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর ‘ফেসবুক পোস্টে সচেতন করেন মানুষকে’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এতে কাজ করা আগের চেয়ে অনেকটাই সহজ হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় সাঈদ তাঁর ব্যাগে ছোট একটি মাইক রাখেন। বাস যখন জ্যামে আটকা পড়ে, তখন মাইক বের করে নিজের পরিচয় দিয়ে সিএনজিচালতি অটোরিকশা বা ট্রেন ও বাসের জানালার কাছে বসে মোবাইল ব্যবহার না করা, কানে হেডফোন লাগিয়ে রাস্তা পার না হওয়া, মোটরসাইকেল আস্তে চালানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। শুরুতে অবশ্য তিনি নিজের পরিচয় দিতেন না। এতে অনেকে ভাবতেন, এসব করে টাকা কামানোর ‘ধান্দা’ করছেন।
ছবির মাধ্যমে কেন সচেতনতা তৈরির চেষ্টা—এ প্রসঙ্গে সাঈদ বললেন, মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে। অনেকেই ভিডিও ফুটেজ দেখার সময় পান না। আর ফেসবুকও আগে এত জনপ্রিয় ছিল না। আর ছবি দেখে মফস্সল থেকে আসা পড়তে না পারা একজন ব্যক্তিও অপরাধ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন, সচেতন হতে পারেন।
সাঈদের একমাত্র ছেলে সাঈদ আব্দুর রহমানের বয়স ১৯ মাস। ছেলের জন্মের পর যে তোয়ালে জড়িয়ে সাঈদ কোলে নিয়েছিলেন, সেই তোয়ালেতে লেখা ছিল—‘মানবিক মানুষ হব’। এখন সময় পেলেই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বের হন, ছেলের ‘হাত দিয়েই’ ভিক্ষুককে খাবার দেওয়ান। ছেলে সচেতন ও মানবিক মানুষ হিসেবে বড় হবে বলেই বিশ্বাস করেন সাঈদের। সচেতনতা তৈরিতে যে মুখে ডাকি ‘মা’, সে মুখে মাদককে বলি ‘না’—এমন একটি লিফলেটে সাঈদ তাঁর মা সুলতানা রাজিয়ার ছবিও ব্যবহার করেছেন।
চরিত্রের প্রয়োজনে ছেঁড়া জামা–কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের কস্টিউম বা পোশাক পরতে হয় সাঈদকে। স্ত্রী সাদিয়া মেমী এসব পোশাক যত্ন করে গুছিয়ে রাখাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করেন। আর ছবি তুলে দেওয়া, বাসের যাত্রী সাজাসহ অন্যান্য চরিত্রে থাকেন ঘনিষ্ঠ কয়েক বন্ধু।
সাঈদ হাসতে হাসতে বললেন, ‘চরিত্রের প্রয়োজনে আমাকে চুল বা দাড়ি বড় রাখতে হয়। তাই সিএনজির (অটোরিকশা) ছাদ কেটে মোবাইল ছিনতাই করছি, এমন ছবি তুলতে গিয়ে গণধোলাইয়ের শিকার হতে যাচ্ছিলাম। এ ছাড়া, এ ধরনের ছবি তোলা বেশ ঝুঁকির কাজ। তবে “সচেতন মানুষ, নিরাপদ বাংলাদেশ”—এ স্লোগান নিয়ে সচেতনতার ফেরিওয়ালা হিসেবে আমি কাজটি করে যেতে চাই।’