সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বন্যার্ত মানুষের সেবায় ব্যস্ত সফি আহমদ (ডানে)
সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বন্যার্ত মানুষের সেবায় ব্যস্ত সফি আহমদ (ডানে)

একজন সফি ও তাঁর ‘মানবিক টিম’

সফি আহমদ

পুলিশও মানবিক—এমন ধারণা ছড়িয়ে দিতেই কাজ শুরু করেন নায়েক মো. সফি আহমদ। কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিনের দায়িত্ব শেষে শুরু হয় তাঁর মানবিক কাজ। সাধ্যমতো অসহায় ও বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ান। শুরুর গল্পটা ছিল তাঁর একার। এখন শফির পাশে আছেন পুলিশেরই অন্তত পাঁচ হাজার সদস্য।

২০১৪ সালে পুলিশে যোগদানের পর সফি ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে কাজ শুরু করেছিলেন, ধীরে ধীরে এর পরিসর বাড়ছে। কনস্টেবল থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এখন সফিকে আর্থিক অনুদান দিচ্ছেন। তা দিয়ে কারও খাবারের ব্যবস্থা করছেন। কারও জন্য ঘর করে দিচ্ছেন। কেউ পাচ্ছে শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ। গত আট বছরে প্রায় এক লাখ মানুষ নানাভাবে সফির সেবা পেয়েছেন।
সফি আহমদ জানান, তাঁর সেবামূলক কাজে এখন পুলিশ ও পুলিশের বাইরে থাকা ৫০ জন তরুণ সমাজকর্মী সম্পৃক্ত আছেন। ‘মানবিক টিম’ নাম দিয়ে তাঁরা কাজগুলো পরিচালনা করছেন। বৃক্ষরোপণ, শিক্ষাবৃত্তি, নগদ টাকা প্রদান, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, বিনা মূল্যে ওষুধ ও অক্সিজেন সরবরাহ, স্বেচ্ছায় রক্তদান, কৃষকদের বীজ বিতরণ এবং মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে সেলাই মেশিন, গবাদিপশু, ভ্যান গাড়িসহ বিভিন্ন উপহারসামগ্রী দিচ্ছেন তাঁরা। পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, বাল্যবিবাহ, মাদক ও যৌতুক প্রতিরোধে নিয়মিত লিফলেট বিতরণ, সচেতনতামূলক সভা, সেমিনার করছেন।

যেভাবে শুরু

সফির বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার চাতলগাঁও গ্রামে। সিলেটের মদনমোহন কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। ছাত্রাবস্থাতেই একজন সমাজকর্মী হিসেবে পরিচিতি পান। মানুষের বিপদে-আপদে ছুটে যেতেন। ২০১০ সালে তিনি সিলেটে এসে কলেজে ভর্তি হন। ২০১৪ সালে পুলিশে তাঁর চাকরি হয়। বর্তমানে তিনি সিলেট মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিটি সার্ভিসে নায়েক পদে কর্মরত।

পুলিশে যোগ দেওয়ার পর সফির সমাজসেবার পরিসর আরও বাড়ে। নিজের বেতনের টাকার পাশাপাশি প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার ভাতার টাকার প্রায় পুরোটাই তিনি বিপদগ্রস্ত মানুষের পেছনে ব্যয় করতেন। ২০২১ সালে তাঁর চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় মানবিক টিম। সফির কাজে মুগ্ধ হয়ে এ দলে পুলিশ, প্রবাসী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতি মাসে সাধ্যমতো আর্থিক অনুদান দেন। এতেই চলে সফি ও তাঁর সঙ্গীদের সমাজসেবামূলক কাজ। আর্তমানবতার সেবায় মানবিক পুলিশিংয়ের জন্য ২০২০ সালে সফি রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। একই বছর তিনি পেয়েছেন শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ডও।

সফি সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন, সিলেটের সভাপতি এবং সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সিলেটের সাবেক সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সফি আহমদ সমাজসেবামূলক যে কাজ নিরন্তর করে চলেছেন, তা সবার জন্যই অনুসরণযোগ্য এবং দৃষ্টান্তমূলক। তাঁর মানবিক উদ্যোগ সিলেটে বিপুলভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। তিনি তাঁর কাজ দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন।

দরিদ্র শিশুদের শিক্ষায় কাজ করে মানবিক টিম

সবার জন্য শিক্ষা

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার রেলস্টেশন এলাকায় পথশিশুরা চুরি, ছিনতাইয়ে জড়িত ছিল। এসব শিশু ‘ড্যান্ডি’ নামের মাদকে আসক্ত ছিল। কেউ কেউ ভিক্ষাও করত। এসব ছিন্নমূল শিশুকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সফি ও স্থানীয় কিছু তরুণ ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলোর পাঠশালা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে নৈতিকতা শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের পাঠদান দেওয়া শুরু হয়।
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, কুলাউড়া সরকারি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র মো. রুবেল আহমেদ ও স্নাতক তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবু বক্করসহ স্থানীয় ২৫ তরুণ এই আলোর পাঠশালা এখন পরিচালনা করছেন। তাঁরা বিনা পারিশ্রমিকে শিশুদের পাঠ দিয়ে থাকেন। বর্তমানে এখানে ৫৭ জন শিশু পাঠ নিচ্ছে। এসব শিশুর শিক্ষা উপকরণ, পোশাক ও খাদ্যসহায়তা এখন সফি ও তাঁর মানবিক টিমের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়ে আসছে।

মো. রুবেল আহমেদ জানান, আলোর পাঠশালায় অক্ষরজ্ঞানসহ যাবতীয় পাঠদান শেষে ১৫ জন শিশু এরই মধ্যে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাকিদেরও একইভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে।

গৃহহীনদের ভরসা

সফি জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত তাঁরা মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে মোট ১৫টি গৃহহীন পরিবারকে ঘর করে দিয়েছেন। এ খাতে তাঁদের খরচ হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ টাকা। সম্প্রতি তাঁরা সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ভাতগাঁওয়ে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন।

মানবিক টিমের এক সদস্য জানান, ভাতগাঁওয়ের দরিদ্র কৃষক হেলাল মিয়া (৪০) ও গৃহিণী শাহানা বেগম (৩৫) দম্পতির ৯ বছরের মেয়ে সোহাদা বেগম গত বছরের শুরুতে আগুনে দগ্ধ হয়েছিল। এ খবর পেয়ে তাঁরা মেয়েটির সুচিকিৎসার উদ্যোগ নিয়ে ঢাকায় পাঠান। তার চিকিৎসার খরচ চালাতে কয়েকজন দানশীল ব্যক্তির অনুদানে একটি তহবিলও গঠন করেন। তবে ১৬ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর সোহাদা মারা যায়। সোহাদার চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ টাকা তহবিলে জমা হয়। চিকিৎসার ব্যয় শেষে যে টাকা অবশিষ্ট ছিল, তা দিয়ে চার শতক জায়গা কিনে সোহাদার পরিবারের জন্য একটি আধা পাকা ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের প্রায় দুই লাখ টাকা স্থায়ী আমানতও করে দেওয়া হয়।

সোহাদার মা শাহানা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। মাইয়াটারে বাঁচাইবার লাগি তারা (মানবিক টিম) চেষ্টার ত্রুটি করছে না। এখন তারা ঘরও বানাইয়া দিছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই পাইলাম।’

অসহায় ও দরিদ্র শিশুদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন সফি আহমদ

বিনা পয়সায় চিকিৎসা

অসহায় মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ২০১৪ সাল থেকেই ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহায়তা করতেন সফি। রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসক দেখানো থেকে শুরু করে ওষুধপত্রও কিনে দিতেন। এখন এ কাজ চলছে মানবিক টিমের মাধ্যমে। এ পর্যন্ত ২০টি মেডিকেল ক্যাম্প করে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে তাঁরা বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি ওষুধও দিয়েছেন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না, এমন এক হাজার ব্যক্তিকে তাঁরা নিজ খরচে চিকিৎসা দেন। এর মধ্যে সুস্থ হলেও কাজ করতে অক্ষম এমন ৫০ জনকে সাবলম্বী করতে সেলাই মেশিন, গরু, ঠেলাগাড়ি, হাঁস-মুরগি, ওজন মাপার যন্ত্র, ভ্রাম্যমাণ পান বিক্রির বাক্স উপহার দিয়েছেন।

সফি জানান, ক্যানসারে আক্রান্ত ২০ জন রোগীকে সার্বক্ষণিক কেমো, ইনজেকশন দেওয়াসহ চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার তাঁরা বহন করছেন। এ ক্ষেত্রে কয়েকজন ফার্মেসিমালিকও তাঁদের বিনা মূল্যে ওষুধ দিয়ে সহায়তা করছেন। প্রায় ৬ হাজার মানুষকে তাঁরা বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে দিয়েছেন। এসবের বাইরে করোনাকালে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের অনুদানে প্রাপ্ত ৪০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে তাঁরা নিয়মিত করোনা রোগীদের সেবা দিয়েছেন।

কঠোর বিধিনিষেধের সময় যখন কেউ ভয়ে করোনা রোগীদের বাসায় যেতেন না, তখন তাঁরা রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। বিভিন্ন সময়ে প্রায় দুই হাজার ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থাও তাঁরা করে দিয়েছেন।

কাজের শেষ নেই

শিক্ষা ও চিকিৎসার পাশাপাশি মানবিক টিম নানামুখী কাজ করে চলেছে। সিলেটের বিভিন্ন স্থানে প্রায় এক হাজার গাছের চারা রোপণ করার পাশাপাশি সেগুলো নিয়মিত পরিচর্যাও করে চলেছেন তাঁরা। প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তাঁরা জঙ্গিবাদ, মাদক, যৌতুকবিরোধী সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়েছেন।

সফি জানান, করোনাকালে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে খাদ্যসামগ্রী ও ১৩ হাজার মানুষকে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছেন তাঁরা। এ সময় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা অর্থসহায়তাও করেছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া অন্তত ৫০ ব্যক্তির মরদেহ দাফন ও সৎকারও তাঁরা করেছেন।

সফি আহমদ আরও জানান, সম্প্রতি সিলেটে সৃষ্ট বন্যায় প্রায় ৩৫ লাখ টাকার খাদ্য, নগদ টাকা, পোশাক ও ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি পুনর্বাসন খাতে তাঁরা ব্যয় করেন। ভবিষ্যতে ছিন্নমূল রোগীদের জন্য একটি ‘সেফটি হাউস’ নির্মাণ এবং অসহায় রোগীদের বিনা মূল্যে হাসপাতালে পরিবহনের কাজে একটি অ্যাম্বুলেন্স কেনার পরিকল্পনা তাঁদের রয়েছে।