যাঁদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়, তাঁদের কারও বাড়ি মৌলভীবাজারে নয়।
যেসব এসআইয়ের আইডি ব্যবহার করা হয়েছে, তাঁরা কিছুই জানতেন না।
ছয় মাসে দেড় হাজার ব্যক্তিকে শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যেতে ‘ক্লিয়ারেন্স’ দিয়েছিল মৌলভীবাজার পুলিশ। এর মধ্যে ৬৭৮ জনকেই ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছিল ভুয়া তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। তাঁদের কারও গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারে নয়। অথচ এই জেলার দুটি থানার ঠিকানা ব্যবহার করে আবেদন করেছিলেন তাঁরা। পাসপোর্টে উল্লেখ করা ঠিকানা থেকে সেটা ভিন্ন হলেও তাঁদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছিল।
এ প্রতিবেদন নিয়ে ওই ব্যক্তিরা মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে চলে গেছেন। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন নারী। জালিয়াতির ঘটনাটি ঘটেছে মৌলভীবাজার সদর ও কমলগঞ্জ থানায়। দুই থানার তিন পুলিশ সদস্য এই জালিয়াতি করেছেন বলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে উঠে এসেছে। তাঁরা হলেন মৌলভীবাজার সদর থানার উপসহকারী পরিদর্শক (এএসআই) কোরবান আলী, কনস্টেবল আল মামুন এবং কমলগঞ্জ থানার কনস্টেবল (কম্পিউটার অপারেটর) লিটন বিশ্বাস।
মৌলভীবাজারের দুই থানা থেকে দেওয়া হয় ৬৭৮টি ভুয়া ক্লিয়ারেন্স। তা নিয়ে বিদেশে গেছেন অনেক নারী।
তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক প্রবীর কুমার ঘোষ বলেছেন, ওই পুলিশ সদস্যরা একটি দালাল চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে জালিয়াতি করে এসব পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ব্যবস্থা করেছিলেন। এর জন্য প্রত্যেক বিদেশগামীর কাছ থেকে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, টাকার বিনিময়ে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের পাসপোর্টের তথ্য যাচাইয়ের ভুয়া প্রতিবেদন (পুলিশ ক্লিয়ারেন্স) দেওয়ার বিষয়টি বছর দেড়েক আগে পুলিশ সদর দপ্তরের নজরে আসে। এরপর পুলিশ সদর দপ্তর ও সিআইডির যৌথ অভিযানে রাজধানীর উত্তরা থেকে দালাল চক্রের হোতা সাহেল শরীফ ও জানে আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় গত বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়। সেটি তদন্ত করতে গিয়ে এই জালিয়াতি ধরা পড়ে।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের ওই তিন পুলিশ সদস্যসহ সাতজনের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য কোরবান ও মামুন জামিনে আছেন। আর লিটন বিশ্বাস পলাতক।
শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যেতে পাসপোর্টধারীদের ‘পুলিশ ক্লিয়ারেন্স’ দরকার হয়। এর জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আবেদনটি প্রথমে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) যায়। সেখান থেকে তথ্য যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানো হয়। যাচাই করে থানা প্রতিবেদন দিলে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেয় পুলিশের বিশেষ শাখা। সিআইডির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১ জুন থেকে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে মৌলভীবাজারের দুই থানা থেকে ৬৭৮টি ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫০৩টি প্রতিবেদন দিয়েছে সদর থানা। আর কমলগঞ্জ থানা দিয়েছে ১৭৫টি।
তদন্তে দেখা গেছে, সদর থানার কম্পিউটার অপারেটর আল মামুন অনলাইনের আবেদনগুলো প্রিন্ট করে থানার ওসির কাছে উপস্থাপন করতেন। তখন ওসি তাঁর অধীন ব্যক্তিদের তদন্তের দায়িত্ব দিতেন। তবে আল মামুন নিজেই গোপনে থানার এসআই আবু সায়েম মো. আবদুর রহমানের পুলিশ আইডি নম্বর ব্যবহার করে যাচাই প্রতিবেদন তৈরি করতেন। পরে এএসআই (মুন্সি) কোরবান সেগুলো ওসির সামনে হাজির করতেন। ওসি স্বাক্ষর করলে প্রতিবেদনগুলো পুলিশের বিশেষ শাখায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো। একই কাজ করেন কমলগঞ্জ থানার লিটন বিশ্বাস। তিনি থানার এসআই আবদুস শহীদ ও ফজলে এলাহীর পুলিশ আইডি নম্বর ব্যবহার করে ভুয়া যাচাই প্রতিবেদন তৈরি করতেন।
এসআই আবদুর রহমান সিআইডিকে বলেন, আবেদনগুলোর কোনোটিই তিনি যাচাই করেননি। ওসির নির্দেশে এএসআই কোরবান ও কনস্টেবল আল মামুন তাঁর আইডি ব্যবহার করে এসব প্রতিবেদন দিয়েছেন। এএসআই কোরবান দাবি করেন, ওসি সাহেবের নির্দেশের বাইরে তাঁর কাজ করার কোনো সুযোগ নেই।
সদর থানার ওসি ইয়াছিনুল হক বলেন, ভুলত্রুটি যদি মানুষের থাকে, একটা বা দুটো যাচাই প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে হতে পারে। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সিআইডির তদন্তে যেটা এসেছে, দু-একটা ঘটনায় নিশ্চয় এমন হইছে।’ন
এদিকে কমলগঞ্জ থানার এসআই ফজলে এলাহীও বলেছেন, তিনি কোনো যাচাই প্রতিবেদন তৈরি করেননি। জানতে চাইলে ওই থানার তৎকালীন ওসি আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, থানার কম্পিউটার অপারেটর লিটনের উপস্থাপন করা কাগজে সরল বিশ্বাসে তিনি স্বাক্ষর করেন।
মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রতিবেদনে যদি ওসিদের স্বাক্ষর থাকে, তাহলে তাঁদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।