আপাতত রাষ্ট্রদূতদের চুক্তিতে নিয়োগ নয়

বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে সরকার নতুন করে কাউকে চুক্তিতে নিয়োগ করছে না। এই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় চুক্তি ও চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হচ্ছে এমন ১০ জন রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরে আসতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া চুক্তিতে থাকা ও অবসরে যাবেন, এমন আরও সাত রাষ্ট্রদূতের চাকরি আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সব মিলিয়ে চলতি বছরে ১৭ জন রাষ্ট্রদূতের পদে রদবদল হবে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটা হবে শীর্ষ কূটনীতিকদের পদে বড় ধরনের পরিবর্তন। এর পাশাপাশি এ বছরের ডিসেম্বরে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের দুই বছরের চুক্তির মেয়াদও শেষ হচ্ছে। এর বাইরে আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রসহ চারটি দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের চুক্তির মেয়াদও শেষ হতে চলেছে।

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত একই বছরে এত বড়সংখ্যক রদবদলের ঘটনা এটাই হবে প্রথম।

সব মিলিয়ে আগামী বছর দেড়েকের মধ্যে ২১ জন রাষ্ট্রদূতের চুক্তি ও চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। এই সময়ে পরিবর্তন আসবে পররাষ্ট্রসচিবের পদেও। কারণ, দেশে ফিরতে বলা ১০ রাষ্ট্রদূতের পাশাপাশি আগামী ডিসেম্বরে চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হবে ভারত, নিউইয়র্কের স্থায়ী মিশন, যুক্তরাজ্য, ব্রাসেলস, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালে নিযুক্ত ছয় রাষ্ট্রদূতের। আর ডিসেম্বরে শেষ হবে রাশিয়ায় চুক্তিভিত্তিক নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বের মেয়াদ। এ ছাড়া গত ২৪ মার্চ পাকিস্তানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. রুহুল আলম সিদ্দিকীকে ঢাকায় বদলি করা হয়েছে।

কূটনীতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরে ১৮টি মিশনে হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূত পদে রদবদল করা হবে। এর পাশাপাশি চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় পররাষ্ট্রসচিব পদেও নতুন একজনকে নিয়োগ দিতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত একই বছরে এত বড়সংখ্যক রদবদলের ঘটনা এটাই হবে প্রথম।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কানাডা, জেনেভা, জার্মানি, জাপান, কুয়েত, পোল্যান্ড থাইল্যান্ড ও ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতেরা চুক্তিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছিল। কিন্তু গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকার এঁদের সবার চুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাসের জন্য বাড়িয়েছিল। অন্যদিকে ইতালি ও গ্রিসে দায়িত্ব পালনরত দুই কূটনীতিকের চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হচ্ছে এপ্রিলে। এরই মধ্যে এঁদের ১০ জনকেই দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আত্মস্বীকৃতি খুনি ও জেলহত্যা মামলায় জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের আত্তীকরণ শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে নানা স্তরের অনেক সেনা কর্মকর্তা যুক্ত হন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এই ধারা অব্যাহত থেকে এরশাদের আমলেও। এর পাশাপাশি রক্ষী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তাও যোগ দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

রাষ্ট্রদূত পদে ৩০ শতাংশের কোটা

বিশ্বের ৫৮টি দেশে বাংলাদেশের ৮১টি দূতাবাস ও উপদূতাবাস রয়েছে। এর মধ্যে সুদানে গৃহযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের দূতাবাসটি আপাতত বন্ধ রয়েছে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে বিদেশে বাংলাদেশের ৮০টি মিশন চালু আছে। আর ৫৭ জন রাষ্ট্রদূত দায়িত্ব পালন করছেন। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে কত শতাংশ রাষ্ট্রদূত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, এর কোনো লিখিত বিধান নেই। তবে এইচ এম এরশাদের শাসনামল থেকে মিশনগুলোতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ নিয়োগের রীতি চালু হয়। স্বৈরাচারী শাসকের আমলে চালু হওয়া ওই প্রথা নব্বই–পরবর্তী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকার অনুসরণ করে আসছে। কখনো কখনো বিভিন্ন সরকারের আমলে রাষ্ট্রদূত নিয়োগের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সাধারণত প্রেষণে মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিতে থাকা বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনায় পছন্দের ব্যক্তিদের চুক্তিতে নিয়োগ করা হয়ে থাকে।

প্রসঙ্গত, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আত্মস্বীকৃতি খুনি ও জেলহত্যা মামলায় জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের আত্তীকরণ শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে নানা স্তরের অনেক সেনা কর্মকর্তা যুক্ত হন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এই ধারা অব্যাহত থেকে এরশাদের আমলেও। এর পাশাপাশি রক্ষী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তাও যোগ দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

চাকরি শেষে দুই বছর, চুক্তির নতুন ধরন

রাষ্ট্রদূতদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও নিয়মিত চাকরি শেষে দায়িত্বের মেয়াদ বাড়ানোর ফলে মাঝারি পর্যায়ের কূটনীতিক, বিশেষ করে রাষ্ট্রদূত পদে দায়িত্ব পালনের জন্য অপেক্ষমাণদের ওপর প্রভাব পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত চাকরি শেষে দায়িত্বের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর ধারাটি মোটামুটি স্থায়ী হতে শুরু করে। খুব স্বাভাবিকভাবে এতে সবার মধ্যে চাকরির মেয়াদ শেষে দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার একধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।

সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন কূটনীতিক এই প্রতিবেদককে চাকরি শেষে দুই বছরের চুক্তিতে রাষ্ট্রদূতদের দায়িত্ব রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, এভাবে রাষ্ট্রদূতদের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ায় যাঁরা রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের অপেক্ষায় থাকেন, তাঁদের পদায়ন বিঘ্নিত হয়। অর্থাৎ চাকরির মেয়াদ শেষে দুই বছরের চুক্তি না দিলে অপেক্ষমাণ কূটনীতিকদের স্বাভাবিক নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। সম্প্রতি ফরেন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় এ প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। তাঁরা দুই বছরের চুক্তির ধারা ভবিষ্যতে অনুসরণ না করার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান।

নিয়মিত চাকরিতে আছেন, এমন কূটনীতিককে বাদ দিয়ে সাবেক কূটনীতিককে চুক্তিতে নিয়োগের সিদ্ধান্তটাই রাজনৈতিক।
মো. তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

কে হচ্ছেন পরবর্তী পররাষ্ট্রসচিব

বাংলাদেশের ২৬তম পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়। এর আগেই তাকে দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী আগামী ৫ ডিসেম্বর মাসুদ বিন মোমেনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। স্বাভাবিক নিয়মেই পররাষ্ট্রসচিবের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে তাঁর উত্তরসূরি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই মুহূর্তে পরবর্তী পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে দুই কর্মকর্তা লন্ডনে নিযুক্ত হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম ও ভারতে নিযুক্ত হাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমানের নাম আলোচনায় রয়েছে। অথচ একাদশ বিসিএস (পররাষ্ট্র ক্যাডার) ব্যাচের ওই দুই কর্মকর্তার যথাক্রমে চলতি বছরের ২৬ ও ৩১ ডিসেম্বর অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার কথা। ফলে তাঁদের কাউকে পররাষ্ট্রসচিব করা হলে ওই সময়ের কয়েক মাস আগেই নিয়োগ দিতে হবে।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন

এরপর পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁর চাকরি চুক্তিতে বাড়াতে হবে। গত দুই দশকের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে কাউকে বেছে নেওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে তাঁকে চুক্তিতে নিয়োগের ঘটনা ঘটেনি। ওই দুই কর্মকর্তার কাউকে পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে নির্বাচিত করা হলে এবারই সেটা প্রথমবারের মতো ঘটবে।
প্রসঙ্গত, পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে মাসুদ বিন মোমেনের উত্তরসূরি হিসেবে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমার কথা ২০২২ সালের শুরুতে শোনা গিয়েছিল। পরে সরকার মাসুদ বিন মোমেনকে চুক্তিতে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়। ওই বছরের জুনে রাবাব ফাতিমা জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক সরকার গুরুত্বপূর্ণ দেশ বিবেচনায় নিয়ে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতেই পারে। তাই নিয়মিত চাকরিতে আছেন, এমন কূটনীতিককে বাদ দিয়ে সাবেক কূটনীতিককে চুক্তিতে নিয়োগের সিদ্ধান্তটাই রাজনৈতিক। এ ক্ষেত্রে কনিষ্ঠ কূটনীতিক জ্যেষ্ঠজনের চেয়ে ভালো কাজ করবেন না, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

তাঁর মতে, রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন কূটনীতিক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। তাই চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদের পর পেশাদার কূটনীতিকদের দুই বছর করে চুক্তিতে নিয়োগের কোনো কারণ দেখি না। কয়েক বছর আগে থেকে স্বাভাবিক নিয়মে পেশাদার কূটনীতিকদের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্বে পাঠালে নিয়োগের প্রক্রিয়াটা সহজ হতো।