ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই আমগাছে মুকুল দেখতে অভ্যস্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের আমচাষি ইসমাইল খান। কিন্তু তিনি এবার এর ব্যতিক্রম দেখলেন। মুকুল আসতে আসতে ফেব্রুয়ারির শেষ এমনকি কোনো কোনো স্থানে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ লেগে গেল। মুকুল না হয় দেরিতে এল। এরপরের ক্ষতিটা হলো মার্চের মাঝামাঝি সময়ে। টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে বিলম্বিত মুকুলের অনেকগুলো পচে গেল। যেগুলো থাকল সেগুলো থেকে গুটি ধরা বাধাগ্রস্ত হলো এপ্রিলজুড়ে চলা তাপপ্রবাহে।
শুধু ইসমাইল নন, দেশের আম উৎপাদনের এক অতিপরিচিত এ এলাকার একাধিক চাষির সঙ্গে কথা বলে এমন অভিজ্ঞতার কথাই শোনা গেল।
ইসমাইল খান এবার জেলার শিবগঞ্জ ও গোমস্তাপুর উপজেলা মিলিয়ে ৮০ বিঘা জমিতে আমের চাষ করেছেন। এর মধ্যে আছে ফজলি, ল্যাংড়া, লক্ষ্মণভোগ ও বারোমাসি। তিনি ২০ বিঘায় যে ফজলি ও ল্যাংড়ার চাষ করেছেন, সেখান থেকে ২০০ মণের বেশি আম পাবেন না বলে মনে করছেন। অথচ স্বাভাবিক ফলন হলেও এর পরিমাণ হতো ৬০০ মণ।
ইসমাইল খান বলছিলেন, ‘এবার কীটনাশকের খরচ উঠবে বলে মনে হয় না। এখন ভরসা বারোমাসি আমের বাগানটি। সেখান থেকে কিছুটা খরচ উঠে আসতে পারে বলে মনে হয়। এমন অবস্থা আগে দেখিনি।’
আম চাষের মাঠের এ চিত্র ভাবিত করেছে এ চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক বা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকেও। সরকারের এ দপ্তরের ‘রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের’ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর অন্তত ১৫ শতাংশ আম উৎপাদন কম হতে পারে। গত অর্থবছরে (২০২২-২০২৩) এর আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন আম বেশি উৎপাদন হয়েছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর আম উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ টনের বেশি।
শীত দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে মুকুল আসতে দেরি, তাপপ্রবাহের কারণে অনাবৃষ্টিতে গুটি ঝরে যাওয়া এবং এবার আমের ‘অফ ইয়ার’ হওয়ার জন্য এবার আম উৎপাদন কম হবে বলে মনে করছেন কৃষিবিদ, অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও চাষিরা। এ অবস্থা শুধু উত্তরের জনপদ নয়, দেশের প্রায় সর্বত্র। এর ফলে উৎপাদনের ওপর প্রভাব পড়েছে।
দেশে যতগুলো ফল আছে এর মধ্যে কেবল আমই একটি ফল, যার এক বছর ভালো ফলন হয়, পরের বছর কম হয়। কৃষিবিদেরা আমের এই উৎপাদনের বৈশিষ্ট্যকে ‘একান্তর ক্রমিক ফলন’ বলেন। কৃষিবিদ এবং আম বিষয়ে একাধিক বইয়ের লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায় বলছিলেন, ‘এবার আমের অফ ইয়ার। এবার সংগত কারণেই এর ফলন কম হবে। এরপর বৈরী আবহাওয়া পরিস্থিতি নাজুক করে তুলেছে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে এবার মার্চ মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম তাপমাত্রা ছিল। আবার বৃষ্টিও হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এই আবহাওয়ায় মুকুল এসেছে দেরিতে।
উত্তরের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর আমের জন্য সুখ্যাতি পুরোনো। কয়েক বছর যাবৎ আমের উৎপাদনে এই দুই জেলাকে টেক্কা দিয়ে চলেছে উত্তরের আরেক জেলা নওগাঁ। জেলার সাপাহারের বাসিন্দা সোহেল রানা চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর আমচাষি বনে গেছেন বছর চার-পাঁচেক হলো। এবার তিনি ১৮০ বিঘায় আমের চাষ করেছেন জেলার সাপাহার, পত্নীতলা উপজেলায়। আমের মুকুল দেরি করে এলেও পরিচর্যার কাজ কিন্তু চাষিদের শুরু থেকেই করতে হয়েছে। বৃষ্টি কম হওয়ায় পানির খরচ হয়েছে বেশি। তাই এবার বিঘাপ্রতি অন্তত পাঁচ হাজার টাকা বেশি খরচ হচ্ছে বলে জানান সোহেল রানা।
পুরো এপ্রিল মাসজুড়ে দেশের কোনো না কোনো এলাকায় তাপপ্রবাহ ছিল। এমন অবস্থা ৭৬ বছরে দেখা যায়নি, আবহাওয়া অধিদপ্তর তা জানিয়েছে আগেই। উত্তরের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর এমনিতেই উষ্ণ এলাকা। এবার কম বৃষ্টিতে আমের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
তাপ বেশি হলে বোঁটার সঙ্গে আমের সংযোগস্থলটি নাজুক হয়ে যায়। এতে আম দ্রুত ঝরে পড়ে বলে জানান সরকারের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের’ প্রধান মেহেদি হাসান। তিনি বলছিলেন, ‘এ অবস্থা শুধু উত্তরে নয়, দেশের প্রায় সবখানে দেখা গেছে।’
আম চাষ যাঁদের পেশা, তাঁদের বাদ দিয়ে বাকিদের এবার আমের ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব নয় বলেই ধারণা কৃষিবিদদের।
নওগাঁ জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এ কে এম মনজুরে মাওলা গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমগাছের নিচে গুটি পড়ে ছেয়ে গেছে, এমন দৃশ্য দেখেছি। যেসব চাষি যত্ন নিয়েছেন, তাঁদের আম হয়তো টিকে গেছে। কিন্তু অনেকে তো এমনটা করতে পারেন না। তাঁদের আমের ক্ষতি বেশি হয়েছে। সার্বিকভাবে এবার অন্তত ১৫ শতাংশ উৎপাদন কম হবে বলে আমার ধারণা।’
দেশের আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখানকার আম্রপালি, রাংগুয়াইসহ নানা প্রজাতির আম দেশের নানা স্থানে যায়। পাহাড়ে এমনিতেই পানির সংকট, এর মধ্যে প্রায় খরা পরিস্থিতিতে এবার অন্তত ২৫ শতাংশ কম উৎপাদন হবে বলে মনে করছেন খাগড়াছড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কিশোর কুমার মজুমদার।
একবার ভালো ফলন, অন্যবার কম-এমন বৈশিষ্ট্য সাধারণত দেশের প্রায় সব আমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও নতুন জাতের আমগুলো এমনটা নয় বলেই জানান কৃষিবিদেরা। এখন দেশে সবচেয়ে বেশি হয় আম্রপালি আম। এ ছাড়া বারি-৪ নামের আমটিও ফি বছর একই ফলন দেয়। তবে কম বৃষ্টির জন্য এসব আমও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এর প্রভাব এবার পড়তে পারে দামের ক্ষেত্রে। এখন দেশি টক আম কাঁচা অবস্থায় ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ী।
আম রপ্তানিতে গত বছর বাংলাদেশ রেকর্ড করে। গত বছর ৩ হাজার ৪৫ টন আম রপ্তানি হয়। আগের বছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭৩ শতাংশ। কিন্তু এবার উৎপাদন কম হওয়ায় রপ্তানিতে প্রভাব পড়তে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এখনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘এবার ফলন কম হলেও কৃষকদের আমরা মানসম্মত আম উৎপাদনের ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছি। এই সময়ে গাছে যে আমটি আছে, এটি যেন অপরিপক্ব অবস্থায় সংগ্রহ করা না হয়। এখনই আম বাড়ন্তের সময়।
এখন সঠিক পরিচর্যা ও প্রয়োজনীয় সেচ দিলে আমের আকার বড় হবে এবং ওজন বাড়বে। আমের আকার ও ওজন বাড়াতে পারলে আমের সংখ্যা কম হলেও সার্বিকভাবে উৎপাদন ঘাটতি কমে আসবে।’