শিশুর জন্মনিবন্ধনের আবেদনের নিয়ম শিথিল হলেও তা নিয়ে সরকারিভাবে প্রচার নেই। ফলে অনেকে নতুন নিয়ম সম্পর্কে জানেন না। কেউ কেউ বলেছেন, অনলাইনে নিবন্ধনের আবেদন করতে গিয়ে কী পরিবর্তন এসেছে তা বুঝতে পারছেন না। কারণ, এখনো ফরমে পিতা–মাতার জন্মনিবন্ধন নম্বরের ঘর রয়ে গেছে। কেউ কেউ নিয়ম শিথিল হওয়ায় তথ্য গোপন করে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্মসনদ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকে জানতে চেয়েছেন, ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের টিকা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হওয়ায় নিয়ম সাময়িকভাবে শিথিল করা হয়েছে কি না? নিয়ম শিথিল নিয়ে অনেকের এমন অনেক প্রশ্ন।
গত ২৭ জুলাই থেকে ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’ জন্মনিবন্ধনের নতুন নিয়ম করেছে, সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে হলে মা–বাবার জন্মসনদ লাগবে না। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নিয়মে পরিবর্তন এনে বলা হয়েছিল, ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের জন্মনিবন্ধন করতে হলে তার মা–বাবার জন্মনিবন্ধন সনদ অবশ্যই প্রয়োজন হবে।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেল চারটায় অনলাইনে (bdris.gov.bd) জন্মনিবন্ধনের আবেদন ফরমটি পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মা–বাবার জন্মনিবন্ধন নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর চাওয়া হলেও সেটা বাধ্যতামূলক (লাল তারকা চিহ্ন) নয়। সে ঘরগুলো পূরণ না করলেও পরবর্তী ধাপে যাওয়া যায়। আবেদন ফরমের ওই পাতায় মা–বাবার নাম (বাংলা ও ইংরেজিতে) ও জাতীয়তার পরিচয় দেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে পরবর্তী ধাপে ১৮ বছরের নিচের বয়সীদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মা–বাবা ছাড়া অন্য কেউ আইনি অভিভাবক হলে তাঁর জন্মনিবন্ধন নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক।
নতুন নিয়মে জন্মনিবন্ধনের বিষয়টি কতটা প্রভাব ফেলেছে, জানতে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল–৫ এ খোঁজ নেয় প্রথম আলো। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আবেদন গ্রহণ ও সনদ বিতরণ কক্ষের সামনে বরাবরের মতো দীর্ঘ লাইন। সরু জায়গায় গাদাগাদি করে লোকজন দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ এসেছেন নতুন আবেদন নিয়ে, কেউ সনদ সংগ্রহ করতে, আবার কেউ সংশোধনের বিষয়ে জানতে এসেছেন।
রাজধানীর অদূরে আমিনবাজার থেকে এসেছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি ১১ বছর বয়সী মেয়ে সুরাইয়া আক্তার ও ৫ মাস বয়সী ছেলে জাহিদুল আলমের জন্মনিবন্ধনের আবেদন ফরম জমা দিতে এসেছিলেন। প্রথম আলোকে জানালেন, মা–বাবার জন্মনিবন্ধন লাগবে না—এটা তিনি জানেন না। মঙ্গলবার সকালে অনলাইনে আবেদন করেছেন। আবেদনে মা–বাবার জন্মনিবন্ধন নম্বর চাওয়া হয়েছে। তাঁর ও স্ত্রীর জন্মনিবন্ধন নম্বর থাকায় তা আবেদন ফরমের নির্দিষ্ট ঘরে উল্লেখ করেছেন। তবে সঙ্গে (বিদ্যুৎ বা পানি বা গ্যাসের বিল বা গৃহকর বাবদ টাকা দেওয়ার রসিদ) প্রয়োজনীয় কাগজ না আনায় আবেদন জমা দিতে পারেননি।
মোহাম্মদপুর থেকে আসা নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি গত সোমবার সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হওয়া পত্রিকার খবর থেকে নতুন নিয়মের বিষয়ে জেনেছেন। অথচ মাত্র দুই দিন আগে সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করতে স্ত্রী ও নিজের জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন। তখন জানতেনও না যে মা–বাবার সনদ আর লাগবে না। তিনি বললেন, ‘বহু ভোগান্তি হয়েছে আমার ও স্ত্রীর জন্মনিবন্ধনের করার জন্য কাগজ জোগাড় করতে। আগে জানলে এই ভোগান্তি হতো না। আজ সনদ পাওয়ার কথা ছিল, পাব কি না, তা জানতে এসেছি।’ তিনি জানান, এক সন্তানের জন্মনিবন্ধন নম্বর ডিজিটাল করতে এবং দুই সন্তানের জন্য নতুন আবেদন করতে তাঁরা আগের নিয়ম অনুসারে আবেদন করেছেন।
সাভার থেকে ময়না আক্তার ও তেজগাঁও থেকে জুনায়েদ চৌধুরী এসেছিলেন জন্মনিবন্ধন নম্বর অনলাইনভুক্ত করার কাজে। তাঁদের নতুন করে আবেদন করতে পরামর্শ দেওয়া হয় নিবন্ধন কার্যালয় থেকে। নতুন নিয়মের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে দুজনই জানান, নতুন নিয়মের বিষয়ে তাঁরা কিছু জানেন না। কার্যালয় থেকেও নতুন নিয়ম সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি। জুনায়েদ চৌধুরী বলেন, ভোগান্তির ভয়ে এক বছর ধরে তিনি সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করাচ্ছিলেন না।
নিবন্ধন কার্যালয়ের এক কর্মী জানান, সাধারণত দিনে ১৫০টির মতো আবেদন পান তাঁরা। তবে এখন ২৫০টির মতো আবেদন আসছে দিনে। এত বাড়ার কারণ কি জানতে চাইলে বলেন, শিশুদের টিকা কার্যক্রম চলছে এ জন্য আবেদন বেড়েছে।
অঞ্চল–৫–এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এস এম ওয়াসিমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ১০–১২ দিন ধরে নতুন নিয়মের আবেদন পাচ্ছেন তাঁরা। অনেক আবেদনে মা–বাবার জন্মনিবন্ধন নম্বর নেই। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা জারি না হওয়ায় শুরুতে মা–বাবার জন্মনিবন্ধন নম্বর ছাড়া এ ধরনের আবেদন পাওয়ার পর আমরা রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে জানানো হয়, নতুন নিয়ম হয়েছে। পরে সেসব আবেদন গ্রহণ করা হয়।’
মিরপুর–৪ অঞ্চলের সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফিরোজ আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কার্যালয়ে কর্মরত ব্যক্তিদের আজ তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, মা–বাবার জন্মনিবন্ধন নম্বর ছাড়া কোনো আবেদন এলে সেগুলো গ্রহণ করতে এবং লোকজনকে নতুন নিয়মের ব্যাপারে জানানো হয়। তবে সদ্য বাতিল নিয়মে মা–বাবার নিবন্ধন নম্বরের সঙ্গে শিশুর পরিচিতি তৈরি এবং একক পরিচয়পত্র (ইউনিক আইডি) তৈরির প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনত বলে তিনি মনে করেন।
ওই কার্যালয়ে আজ ইহান আবদুল্লাহ নামে ছয় বছর বয়সী এক শিশুর জন্মনিবন্ধন নম্বর ইস্যু হয়েছে, যার বাবার জন্মনিবন্ধন নম্বর থাকলেও মায়েরটা নেই।
তবে নানা কাগজপত্রের মারপ্যাঁচে জন্মনিবন্ধনের ভোগান্তি রয়ে গেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। অঞ্চল–৫–এ রুবিনা বেগম নামের এক নারী জানান, তিনি বাড্ডায় এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন। পড়াশোনা জানেন না। স্বামী নেই। তাঁর দুই ছেলের জন্মনিবন্ধন করাতে এসেছেন। দুই মাস ধরে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর প্রমাণ ও সন্তানদের জন্মের প্রমাণ হিসেবে কাগজপত্র জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। নিবন্ধন কার্যালয়ে কেউ তাঁকে তথ্য দিয়েও সহায়তা করছেন না।
তথ্য গোপন করে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্মসনদ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, সাধারণ নিয়মে রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলাদেশের জন্মসনদ পাওয়ার অধিকার নেই। তাদের চলাচল কক্সবাজারে নিয়ন্ত্রিত। রোহিঙ্গা নাগরিকদের নাম, ঠিকানা, ছবি এবং আঙুলের ছাপ নিয়ে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে। কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় রোহিঙ্গাদের বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখে। এ ছাড়া জন্মনিবন্ধনের আবেদন করলে স্থানীয় পর্যায় থেকে কাগজপত্র যাচাই–বাছাই হয়। সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা নাগরিক হলে যাচাইয়ে ধরা পড়ার কথা। এরপরও এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে কি না, তা পর্যবেক্ষণে রেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়।
নতুন নিয়ম নিয়ে নাগরিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের বিষয়ে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল মির্জা তারিক হিকমত প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন ধরে সময়ে সময়ে সফটওয়্যার হালনাগাদ করা হচ্ছে। কোনো সমস্যার কথা জানা গেলে সফটওয়্যারে তা সংশোধন করা হচ্ছে। টিকা কার্যক্রমের জন্য জন্মনিবন্ধনের নিয়ম শিথিল করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা একেবারেই ভুল কথা। টিকার জন্য নিয়ম শিথিল হয়নি, জনসাধারণ নানা ভোগান্তির কথা বলছিলেন, সে কারণে করা হয়েছে। আবেদন ফরমে মা–বাবার জন্মনিবন্ধন নম্বর চাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সেটা বাধ্যতামূলক নয়। জাতীয়তার পরিচয় দেওয়া বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে।
এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (উপসচিব) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা প্রথম আলোকে বলেন, ৯ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিকের ডেটাবেজ রয়েছে। তাদের নির্দিষ্ট নম্বর, ফ্যামিলি কার্ড রয়েছে। এখন যেসব পদ্ধতি চালু রয়েছে, তাতে রোহিঙ্গা নাগরিকদের বাংলাদেশের ভোটার হওয়া, জন্মনিবন্ধন করা বা পাসপোর্ট পাওয়া কঠিন। অবৈধভাবে কোনো রোহিঙ্গা নাগরিক এ ধরনের চেষ্টা করলেও কোনো না কোনো পর্যায়ে ধরা পড়বে।