শ্বেতপত্র
শ্বেতপত্র

খসড়া শ্বেতপত্রে কৃষি খাত

কৃষিঋণ, কেনাকাটা, ভর্তুকি সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির ছড়াছড়ি

আওয়ামী লীগের শাসনামলে কৃষির যেসব খাতে অর্থ খরচ হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিতে দুর্নীতি পেয়েছে অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাষ করে সবচেয়ে কম লাভ পেয়েছেন ধানচাষিরা। কৃষিঋণ পেতেও ভুগতে হয়েছে কৃষকদের। ঘুষ দিতে হয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। শুধু কৃষিঋণ নয়, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ভর্তুকি থেকে শুরু করে সরকারের ধান-চাল কেনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে।

কৃষি খাত নিয়ে এমনই কথা বলা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের করা খসড়া শ্বেতপত্রের কৃষি ও খাদ্য পরিস্থিতির অংশে। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে কৃষির যেসব খাতে অর্থ খরচ হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিতে দুর্নীতি খুঁজে পেয়েছে অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এসব দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে প্রতিবেদনে এর আগের সরকারের আমলে হওয়া সরকারি তদন্ত প্রতিবেদন, গবেষণা ও সমীক্ষা প্রতিবেদনগুলোর সহায়তা নেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনকেও সূত্র হিসেবে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে কৃষির বড় একটা অংশ অনানুষ্ঠানিক খাত হিসেবে পরিচালিত হয়। মূলত সরকারি কেনাকাটা, প্রকল্প ও ঋণ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেখানে আমরা বেশ কিছু দুর্নীতির চিত্র পেয়েছি। তবে সামগ্রিকভাবে আরও অনেক ধরনের দুর্নীতি এখানে হয়েছে, যা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন

জানতে চাইলে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে কৃষির বড় একটা অংশ অনানুষ্ঠানিক খাত হিসেবে পরিচালিত হয়। মূলত সরকারি কেনাকাটা, প্রকল্প ও ঋণ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেখানে আমরা বেশ কিছু দুর্নীতির চিত্র পেয়েছি। তবে সামগ্রিকভাবে আরও অনেক ধরনের দুর্নীতি এখানে হয়েছে, যা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

কৃষি খাতে যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে সরকার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়। উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের জন্য ৭০ শতাংশ, অন্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে ১২ ধরনের উচ্চ মূল্যের কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করা হয়। মোট ২ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন ছিল ১ হাজার ৭৬২টি। কিন্তু তৎকালীন সরকারের ওই ভর্তুকির বড় অংশ দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তায় চলে যায় ব্যবসায়ীদের হাতে।

তৎকালীন সরকার ২০২১-২২ সালে কৃষি খাতে ৯ ও ৮ শতাংশ হারে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ওই খাতে সর্বনিম্ন ৪ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য এসএমই ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক নেতা ও দুর্নীতিবাজ আমলারা এখান থেকে সম্পদ বানানোর উদ্যোগ নেন। একজন সাবেক পুলিশপ্রধান বা আইজিপির (বেনজীর আহমেদ) বিরুদ্ধে তাঁর অবৈধ সম্পদকে বৈধতা দিতে কৃষি ও মৎস্য খাতে বিনিয়োগকে ব্যবহার করা হয়। ওই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে আবার সরকারের পক্ষ থেকে ২০২০-২১ সালের জন্য সেরা কর্মকর্তা হিসেবে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ দেওয়া হয়।

কৃষির কোন পণ্য উৎপাদনে আমরা কততম ছিলাম, এত দিন সেই গল্প বেশি শুনেছি। কিন্তু কৃষি খাতে সরকারি বরাদ্দের কত অংশ দুর্নীতি ও চুরি হয়েছে, তা আমরা খুব কম জেনেছি।
বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান

সরকার কৃষকদের উৎপাদনে সহায়তার কথা বলে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৭৬ বিলিয়ন টাকা কৃষিঋণ হিসেবে দেয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ওই ঋণ পেতে কৃষকদের ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের মোট ১২ বিলিয়ন টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে কৃষকদের।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষির কোন পণ্য উৎপাদনে আমরা কততম ছিলাম, এত দিন সেই গল্প বেশি শুনেছি। কিন্তু কৃষি খাতে সরকারি বরাদ্দের কত অংশ দুর্নীতি ও চুরি হয়েছে, তা আমরা খুব কম জেনেছি।’