শ্বেতা শতাব্দীর জন্মদিন আজ। তবে তাঁর চিন্তা এখন জটিল রোগ আর চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে
শ্বেতা শতাব্দীর জন্মদিন আজ। তবে তাঁর চিন্তা এখন জটিল রোগ আর চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে

‘হাতের নাগালে শ্বেতার জীবন’

শ্বেতা শতাব্দী এষ একটি নতুন পাণ্ডুলিপির কাজে হাত দিয়েছেন। কবিতার পাশাপাশি উপন্যাসও লিখতে চান। কিন্তু হাতে সময় হয়তো খুব বেশি নেই। জন্ম থেকেই ‘বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর’ রোগের সঙ্গে শ্বেতার বসবাস। গত জুন থেকে থ্যালাসেমিয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে লিভার ক্যানসার। চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে থেরাপি দিতে হবে। থেরাপিতে ব্যয় হবে প্রায় ৩২ লাখ টাকা।

তরুণ কবি শ্বেতার চিকিৎসায় বিভিন্ন সময়ই মানুষ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এবারও বিভিন্ন সংস্থা এবং ব্যক্তিদের কাছ থেকে ২২ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এই টাকা নিয়েই ১৫ অক্টোবর শ্বেতা তাঁর বড় বোন মন্দিরা এষকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে রওনা দেবেন। সেখানে গিয়ে আগে একটি পরীক্ষা করতে হবে। সে পরীক্ষায় জানা যাবে, শ্বেতা আরেকজন রোগীর সঙ্গে ট্যার থেরাপিটি ভাগাভাগি করে নিতে পারবেন কি না। অর্থাৎ দুজন রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি একই রকম হলে ওষুধ ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। এতে থেরাপির খরচটা কমে যাবে। এ থেরাপি শেষ হলে পরে লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য আবার ঝক্কি পোহাতে হবে।

এ পর্যন্ত শ্বেতার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫। সবই কাব্যগ্রন্থ। সেগুলো হলো ‘অনুসূর্যের গান’, ‘রোদের পথে ফেরা’, ‘ফিরে যাচ্ছে ফুল’, ‘আলাহিয়ার আয়না’ এবং ‘বিপরীত দুরবিনে’। মানুষ, মানুষের মনোজগৎ, সম্পর্ক, বিষণ্নতা—এগুলো নিয়েই লিখতে ভালোবাসেন শ্বেতা।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর পশ্চিম কাজীপাড়ার বাসায় বসে কথা হলো শ্বেতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। ওরাল কেমোথেরাপির ধকলে মাথার চুল পড়ে যাচ্ছিল। তাই সম্প্রতি মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছেন শ্বেতা। মাথায় নতুন করে যাও–বা চুল গজাচ্ছে, সেই চুল সাদা হয়ে গজাচ্ছে।

বড় বোন মন্দিরা এষের সঙ্গে শ্বেতা শতাব্দী

চুল পড়ে যাওয়ার জন্য শ্বেতার মন খারাপ না হলেও নিজের লেখালেখির টেবিলটির জন্য মন খারাপ করলেন। বললেন, পড়ার টেবিলটি এখন যেন ওষুধের দোকানে পরিণত হয়েছে।

শ্বেতা বললেন, এখন হাসপাতাল, বিশেষ করে অস্ত্রোপচারের টেবিলের কথা মনে হলেই ভয় লাগে। পিত্তথলির অস্ত্রোপচারের পর সংক্রমণ হওয়ায় পিত্তথলি ও প্লীহা কেটে ফেলতে হয়েছে। আর থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার জন্য এখন তিন ব্যাগ রক্ত (রেড সেল) নিতে হচ্ছে।

মুখে ভাত অনুষ্ঠানের দিন জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন ছয় মাসের শ্বেতা শতাব্দী। এরপর চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ‘বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর’ রোগটির কথা প্রথম জানতে পেরেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তবে শ্বেতা পড়াশোনা থামাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। প্রকাশনা সংস্থা দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডে (ইউপিএল) কিছুদিন চাকরি করেন। বাংলা একাডেমিতে একটি কোর্সে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। বাংলা একাডেমিতে দুটো চাকরির লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, যদিও মৌখিক পরীক্ষার জন্য আর ডাক পাননি।

গত মে মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন শ্বেতা। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ১০ জুন তাঁর ক্যানসার শনাক্ত হয়। এরপর ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে গত ৩ আগস্ট দেশে ফিরেছেন শ্বেতা। আবার ভারতে যেতে হচ্ছে তাঁকে। শ্বেতা বললেন, থ্যালাসেমিয়াকে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলেন। চিকিৎসা মেনে চললে অনেক বছরই বেঁচে থাকার আশা ছিল। কিন্তু ক্যানসারকে ঠিক মানতে পারছেন না বা হিসাবটা ঠিক মিলছে না। লিভার প্রতিস্থাপন করতে হলে তো অনেক টাকা লাগবে।

সময় হেরে যাক, বাঁচুক শ্বেতা...: জামালপুরের মেয়ে শ্বেতা। ২০১৭ সালে শ্বেতা অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মেহের নিগার, কাবেরী গায়েন, ইউপিএলের পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিনসহ অন্যরা শ্বেতার পাশে দাঁড়ানোর জন্য সবার কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেবার ২৫ লাখ টাকার বেশি আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলেন। তা থেকে ১৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়েছে শ্বেতার নামে। আর বাকি টাকা তখন শ্বেতার অস্ত্রোপচার ও পরবর্তী জটিলতা সামলাতে ব্যয় করা হয়।

শ্বেতার বাবা ব্যবসায়ী জ্যোতিষ চন্দ্র এষ বর্তমানে কোনো কাজ করছেন না। শ্বেতার বড় বোন মন্দিরা এষ স্ক্রিপ্টরাইটারসহ (ফ্রিল্যান্সার) বিভিন্ন কাজ করে যা আয় করেন, তা দিয়েই তাঁকে সংসার সামলাতে হয়। গ্রামের বাড়িতে ঘরভাড়াসহ কিছু টাকা পাওয়া যায়। তাই বোন শ্বেতার চিকিৎসায় মানুষই ভরসা।

লেখার টেবিলে শ্বেতা শতাব্দী

শ্বেতার পাশে দাঁড়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা মঞ্চনাটকসহ বিভিন্ন আয়োজন করে টাকা সংগ্রহ করেছেন। শিল্পীরা তাঁদের আঁকা ছবি বিক্রির টাকা দিয়েছেন শ্বেতার জন্য। মন্দিরা এষ এ পর্যন্ত ৩৬টি ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা এবং ব্যক্তিদের কাছে শ্বেতার পাশে দাঁড়ানোর জন্য ই-মেইল করেছেন বা সরাসরি কথা বলেছেন। ফেসবুকে শ্বেতার বন্ধু, স্বজনেরা সহায়তা চেয়ে পোস্ট দিচ্ছেন।

ফেসবুকে অন্যদের লেখাতেও প্রাধান্য পেয়েছে ‘হাতের নাগালে শ্বেতার জীবন’ কথাটি। অন্যরাও বলছেন—সময় হেরে যাক, বাঁচুক শ্বেতা, মৃত্যু জানুক, মানুষই বিজেতা।

মন্দিরা এষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েকজন থ্যালাসেমিয়ার রোগী শ্বেতার জন্য ৩০ হাজার টাকা দিয়ে গেছেন বাসায় এসে। এভাবেই শ্বেতা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখার সাহস পাচ্ছেন।’

আজ শনিবার ১২ অক্টোবর শ্বেতার জন্মদিন। শ্বেতার বড় বোন মন্দিরা এষ মুঠোফোনে জানালেন, জন্মদিনে বোনের জন্য ফুল আর একটি কেক আনা হয়েছে। কেক ও ফুলের সামনে শ্বেতা বিষণ্নভাবে বসে আছেন, এমন একটি ছবি পোস্ট করেছেন মন্দিরা।

শ্বেতার মুখে হাসি ফিরিয়ে দিতে কেউ এগিয়ে আসতে চাইলে তাঁর জন্য সহায়তা পাঠাতে পারেন।  সহায়তা পাঠানোর ঠিকানা: শতাব্দী এষ, হিসাব নম্বর: ৪৪৩৯৬০১০১৯০৩৩, সোনালী ব্যাংক পিএলসি; শাখা: বেগম রোকেয়া সরণি, পশ্চিম মনিপুর, ঢাকা; শাখা কোড: ০৬৭; সুইফট কোড: BSONBDDH; রাউটিং নাম্বার: ২০০২৬০৬৭৯। পেপ্যাল https://Paypal.me/AlokanandaB; ই-মেইল: bhmk61@yahoo.com; বিকাশ ও নগদ-০১৭১৫৬২৬২৭৬ (বাবা) ০১৯২১০০৬৬২৭ (বোন)।