চট্টগ্রামের একটি নালিশি মামলার (সিআর) ‘ভুয়া পরোয়ানায়’ ১৪ দিন ধরে কারাগারে থাকা এক কৃষক তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ফেরত চেয়েছেন। তাঁর নাম আজিজুর রহমান। বাড়ি সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের ফিরিঙ্গীকান্দা গ্রামে। আজ বুধবার বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আজিজ আহমেদ ভূঁইয়া তাঁকে মুক্তির আদেশ দেন।
এরপর আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের উপস্থিতিতে নিরপরাধ কৃষক আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া একেকটি দিন কে ফিরিয়ে দেবে?’
গত ৩১ আগস্ট থেকে তিনি কারাগারে আটক আছেন। কিন্তু জামালপুরের আরেকটি ‘ভুয়া পরোয়ানায়’ কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না আজিজুর রহমান। ইতিমধ্যে এটা থেকে মুক্তির জন্য জামালপুর আদালতে আবেদন করেছেন তাঁর আইনজীবী।
এর আগে ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার আদালত থেকে দেওয়া ভুয়া পরোয়ানায় আজিজুর রহমান ১০০ দিন বিনা দোষে কারাভোগ করে মুক্তি পান।
চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামের যে নালিশি মামলায় কৃষক আজিজুর রহমানের নামে পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে এটি সম্পূর্ণ ভুয়া। পরোয়ানায় মামলা নম্বর লেখা হয়েছে সিআর ২৪০৮/২২। অথচ চট্টগ্রামে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২ হাজার ৪০৮ পর্যন্ত সিআর মামলার সিরিয়াল আসেনি। পরোয়ানাটিতে কোনো আদালতের নাম লেখা নেই। শুধু দায়রা জজ আদালত, চট্টগ্রাম সিল রয়েছে। সিআর মামলা চলে চট্টগ্রাম ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। কিন্তু পরোয়ানায় সিল রয়েছে দায়রা জজ আদালতের। আবার পরোয়ানায় যে স্মারক নম্বর দেওয়া হয়েছে তার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
সরকারি কৌঁসুলি আরও বলেন, গত সোমবার আজিজুরের মুক্তির আবেদন করা হয়েছিল জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। আদালত প্রশাসনিক কর্মকর্তা অঞ্জন চৌধুরীকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদন্তে উঠে আসে পরোয়ানাটি পুরোটাই ভুয়া। এ জন্য আদালত বুধবার আজিজুরকে মুক্তির আদেশ দিয়ে ভুয়া পরোয়ানা তৈরির চক্রটিকে শনাক্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, গত ২৬ আগস্ট সাভার থানার একটি মারামারির মামলায় গ্রেপ্তার হন আজিজুর রহমান। ওই মামলায় ৩০ আগস্ট জামিন পান তিনি। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার আগেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর নামে একটি পিডব্লিউ (প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট) যায়। ওয়ারেন্টটি (পরোয়ানা) পাঠানো হয় চট্টগ্রাম আদালত থেকে।
পরোয়ানায় আজিজুরকে ১৩ সেপ্টেম্বর (বুধবার) চট্টগ্রাম আদালতে একটি নালিশি মামলায় (সিআর ২৪০৮/২২) হাজির করতে বলা হয়। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। জামিনের পরও আজিজুর মুক্তি না পাওয়ায় তাঁর স্বজনেরা চট্টগ্রামে হওয়া মামলার খোঁজ নেন। কৃষক আজিজুরের পক্ষে লড়ছেন চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী আবদুল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরোয়ানাটি ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় আদালত মুক্তির আদেশ দেন।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে জামালপুরের একটি মামলায় পরোয়ানা রয়েছে। এ জন্য তাঁকে কাল বৃহস্পতিবার ঢাকা কারাগারে পাঠানো হবে। সেখান থেকে জামালপুরে নেওয়া হবে।
জামালপুর আদালতের আইনজীবী কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, জামালপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের যে মামলা নম্বর দিয়ে কৃষক আজিজুরের নামে পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে সেটি ভুয়া। এ জন্য এই ভুয়া পরোয়ানা থেকে তাঁর মুক্তির জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আজিজুরকে জামালপুর কারাগারে আনার পর আদালতে এই বিষয়ে শুনানি হবে।
কৃষক আজিজুরের ছেলে হাসান আহমেদ দাবি করেন, চট্টগ্রামের মতো জামালপুর আদালতের পরোয়ানাটি ভুয়া বলে তাঁদের জানানো হয়েছে।
আজ বুধবার বিকেলে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের চতুর্থ তলার বারান্দায় পুলিশের উপস্থিতিতে কথা হয় আজিজুরের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো অপরাধ না করে মামলা না থাকলেও ১৪ দিন ধরে কারাগারে আছি। আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া একেকটি দিন কে ফিরিয়ে দেবে? মুক্তি পেলেও জামালপুরের আরেক পরোয়ানায় আর কত দিন জেলে থাকতে হবে জানি না।’
কৃষক আজিজুরের দাবি, এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করায় একটি মহল তাঁর বিরুদ্ধে আদালতের সিল সই জাল করে ভুয়া পরোয়ানাগুলো তৈরি করছে। জড়িতদের শনাক্ত করে তাঁদের বিচার চান তিনি। যাতে আর কোনো নিরীহ মানুষকে এভাবে হয়রানির শিকার হতে না হয়।
এর আগে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার চারটি মামলায়, রাজধানীর মিরপুর থানার একটি মামলায়, জামালপুরের বকশীগঞ্জ থানার একটি মামলায় ও মাদারীপুর সদর থানার একটি মামলায় পরোয়ানায় ২০১৮ সালে আজিজুরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। এসব মামলায় তাঁকে চট্টগ্রাম, মাদারীপুর ও জামালপুর কারাগারে থাকতে হয়েছিল।
২০১৮ সালের ২৯ মে এক আদেশে চট্টগ্রাম মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ তৃতীয় আদালতের বিচারক বিলকিছ আক্তার বলেছিলেন, চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার মামলায় আজিজুর রহমান নামে কোনো আসামি নেই। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আজিজুরের অন্তর্বর্তীকালীন হাজতি পরোয়ানার ফটোকপিতে শুধু দায়রা নম্বর ছাড়া আর কোনো কিছুর মিল নেই এবং আদালত (চট্টগ্রাম মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ তৃতীয় আদালত) থেকে তাঁর নামে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হয়নি। অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকলে তাঁকে (আজিজুর) মুক্তির নির্দেশ দেন আদালত।
এর দুই দিন পরে ২০১৮ সালের ৩১ মে মাদারীপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এক আদেশে বলেন, আজিজুর রহমানকে হয়রানির জন্য বিচারক ও আদালতের সিল-স্বাক্ষর জাল করে মাদারীপুর সদর থানার একটি মামলায় তাঁর নামে হাজতি পরোয়ানাসহ এক পাতার আদেশনামা তৈরি করা হয়েছে।
এদিকে বাবার মুক্তির জন্য সাভার থেকে চট্টগ্রামে ছুটে এসেছেন আজিজুরের ছেলে হাসান আহমেদ। আদালত প্রাঙ্গণে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০০ দিন হাজত খাটার পর ২০১৮ সালের ১২ জুন তাঁর বাবা মুক্তি পান। ছাড়া পেয়ে হয়রানির প্রতিকার চেয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন তাঁরা।