পুরোনো ছবি-ভিডিও যেভাবে অপতথ্য ছড়াচ্ছে রাজনীতির মাঠে

তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর চিত্র তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আজ রোববার ডিসমিসল্যাবের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি লিখেছেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষক তামারা ইয়াসমীন। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো:

‘বাসে আগুনের চেষ্টা, ছাত্রলীগের ৩ নেতা-কর্মী আটক’ শিরোনামে প্রথম আলো পত্রিকায় ২০১৪ সালে প্রকাশিত সংবাদকে বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মসূচির খবর বলে প্রচার করা হচ্ছে। মূলত ২০১৪ সালে মাগুরায় একটি বাসে আগুন দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাঁরা। অন্য দুটি ছবিও আগের হলেও তা সাম্প্রতিক বলে প্রচার করা হয়েছে

বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বা বিক্ষোভ, কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি পুরোনো ছবি-ভিডিও বা খবরের স্ক্রিনশট শেয়ারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২৮ ও ২৯ জুলাই সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর পাল্টাপাল্টি সমাবেশের ঘটনায়ও এমনটিই দেখা গেছে। সামাজিক মাধ্যমে পুরোনো খবরের স্ক্রিনশট অথবা পুরোনো ছবি ও ভিডিওকে সাম্প্রতিক বলে প্রচার করেছে দুই পক্ষই। ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে এমন অন্তত আটটি নজির পাওয়া গেছে, যা একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তিও শেয়ার করেছেন।

ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনের সদ্য নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত ২৯ জুলাই বিএনপির অবস্থান কর্মসূচির ছবি হিসেবে টুইটারে চারটি ছবি টুইট করেন। যার ক্যাপশনে বলেন, “আজকে #বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের একঝলক। তারা তাদের আসল চরিত্রে ফিরে আসছে!” কিন্তু যাচাই করে দেখা যায়, তাঁর টুইট করা চারটি ছবির অন্তত তিনটিই পুরোনো। একাধিক ফ্যাক্টচেকার বিষয়টি তখনই তুলে ধরেন।

টুইটার পোস্টের স্ক্রিনশট

আরাফাতের পোস্ট করা প্রথম ছবিতে সাদা শার্ট পরা এক যুবককে পুলিশের ওপর চড়াও হতে দেখা যায়। তবে যাচাইয়ে দেখা গেছে, ছবিটি অন্তত আট বছরের পুরোনো। ২০১৫ সালে জাগো নিউজের ‘আবারো নাশকতাকারীদের টার্গেট পুলিশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ছবিটি পাওয়া যায়।

পুলিশের গাড়ির সামনে লাঠি হাতে কয়েকজন যুবকের হামলা করতে যাওয়ার দ্বিতীয় ছবিটিও বিএনপির আহ্বানে পালিত সমাবেশ বা অবরোধের নয়। ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘শাহবাগে পুলিশের উপর হামলা: প্রতিবেদন ১৩ মার্চ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ছবিটি পাওয়া যায়। ছবিটি সে বছর রাজধানীর শাহবাগে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর তদন্ত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে মশালমিছিলের সময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা রয়েছে। একইভাবে তৃতীয় ছবিটিও গত বছর ‘পুলিশের সঙ্গে জামায়াত নেতা–কর্মীদের সংঘর্ষ, আটক ১১’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল।

টুইটারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমও ২৯ জুলাইয়ের ছবি দাবি করে তাঁর ভেরিফায়েড টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করেছেন পুরোনো একটি ছবি। সেখানে আগুনে পুড়তে দেখা যাচ্ছে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাসকে। ছবিটি ২০২০ সালে রাজধানীর প্রগতি সরণির কোকা-কোলা এলাকায় অগ্নিসংযোগের পুরোনো ঘটনার ছবি। তবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর টুইটে যুক্ত করা আরেকটি ভিডিও সাম্প্রতিক সহিংসতাসংশ্লিষ্ট।

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের আরেকটি পোস্টে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের রক্তাক্ত ছবি শেয়ার করে দাবি করা হয়েছে যে সেটি সাম্প্রতিক সময়ের। কিন্তু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের এই রক্তাক্ত ছবিটি আসলে তোলা হয়েছিল ২০১৮ সালে, কেরানীগঞ্জে বিএনপির গণসমাবেশ চলাকালে।

ফেসবুকে ছড়ানো পোস্ট (বামে) এবং ২০১৮ সালের প্রতিবেদনের (ডানে) স্ক্রিনশট

এ ছাড়া ‘বাংলাদেশ বিএনপি নিউজ’সহ আরও কিছু ফেসবুক পোস্টে জেরার মুখে বাসে আগুন লাগানোর কথা স্বীকার করে এক কিশোর নিজেকে ছাত্রলীগের সদস্য দাবি করছে—এমন একটি ভিডিও ছড়াতে দেখা গেছে। তবে ভিডিওটি অন্তত চার বছর আগের। সামাজিক মাধ্যমে ভিডিওটি পাওয়া যায় ২০১৯ সালের ১৯-২০ মার্চ থেকে। মূলত সে বছরের ১৯ মার্চ আবরার আহমেদ চৌধুরী নামের এক বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার জেরে যে আন্দোলন হয়েছিল, ভিডিওটি ছিল সেই সময়ে ধারণ করা।

সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্ট (বামে) এবং ২০১৯ সালের ফেসবুক পোস্টের (ডানে) স্ক্রিনশট

এর বাইরে ‘বাসে আগুনের চেষ্টা, ছাত্রলীগের ৩ নেতা-কর্মী আটক’ শিরোনামে প্রথম আলো পত্রিকায় ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি সংবাদকে বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মসূচির খবর বলে প্রচার করা হচ্ছে। মূলত ২০১৪ সালে মাগুরায় একটি বাসে আগুন দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন তাঁরা। প্রথম আলো এক বিবৃতিতে এটিকে ‘মিথ্যা প্রচারণা’ বলে নিশ্চিত করেছে।

এর আগে ২৮ জুলাই বিএনপির মহাসমাবেশ চলাকালে ঢাকার নয়াপল্টনে এক পুলিশ কর্মকর্তা একজন সাংবাদিককে ছবি তুলতে বাধা দিচ্ছেন, এমন একটি ছবিও বেশ কয়েকটি (১, ২, ৩) পোস্টে ছড়াতে দেখা গেছে। তবে যাচাইয়ে দেখা যায়, ছবিটি তোলা হয়েছিল ২০১৮ সালে পল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির বিক্ষোভ চলাকালে। সেখানে বাংলা টিভির প্রতিবেদক আরমান কায়সার ও ক্যামেরাম্যান মানিককে ছবি তুলতে বাধা দিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার আনওয়ার হোসেন।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ভারতের মণিপুরে চলমান জাতিগত সংঘাতেও পুরোনো ভিডিও ও ছবি ছড়াতে দেখা গেছে, যেগুলো ইতিমধ্যে ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম ও তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে। যেমন একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, কুকিদের শারীরিকভাবে আঘাত করছেন একজন পুলিশ সদস্য। কিন্তু তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান বুম দেখেছে, ভিডিওটি গত বছর ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, মণিপুরের বিধানসভা নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীকে প্রহার করছে।

ভারতের সামাজিক মাধ্যমে চার্চে আগুন জ্বলছে, এমন ভিডিও প্রচার করে বলা হয়েছিল ক্ষমতাসীন বিজেপি এই কাজের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সেখানকার ফ্যাক্টচেকাররা নিশ্চিত করেছে, ভিডিওটি আসলে ফ্রান্সের। একইভাবে মণিপুরের কুকিদের বিরুদ্ধে মেইতেই জনগোষ্ঠী মিছিল করছে—এমন একটি ছবি যাচাই করে দেখা যায়, সেটি ছিল মূলত একটি মাদকবিরোধী মিছিল।