বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন আজ, শিল্পের নতুন দুয়ার খুলছে

আজ উদ্বোধনের পর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে গাড়ি চলাচল শুরু হবে আগামীকাল। তিন থেকে সাড়ে তিন মিনিটে পাড়ি দেওয়া যাবে টানেল। গত বৃহস্পতিবার নগরের পতেঙ্গা প্রান্তে
ছবি: সৌরভ দাশ

সাড়ে চার বছরের নির্মাণযজ্ঞ শেষে খুলে দেওয়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এই টানেল চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা থেকে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে আনোয়ারা উপজেলাকে যুক্ত করেছে। ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সাগর উপকূল ঘিরে শিল্পের নতুন দুয়ার খুলে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার সকালে এই টানেল উদ্বোধন করবেন। পরদিন চার লেনের এই টানেল যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। টোল দিয়েই টানেল ব্যবহার করতে হবে। শুধু দেশেই প্রথম নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে প্রথম সড়ক টানেল এটি।

কর্ণফুলী নদী সারা দেশ থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারকে আলাদা করেছে। প্রায় ৯১ বছর আগে এই নদীর ওপর প্রথম কালুরঘাট রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। এই সেতু থেকে সাত কিলোমিটার ভাটিতে ১৯৮৯ সালে প্রথম সড়ক সেতু নির্মাণ করা হয়। নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় ২০১০ সালে একই স্থানে কর্ণফুলী তৃতীয় শাহ আমানত সেতু নির্মাণ করা হয়।

উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম যোগাযোগপথ বঙ্গবন্ধু টানেল। গতকাল পতেঙ্গা প্রান্তে

শাহ আমানত সেতু থেকে নদীর মোহনা পর্যন্ত নতুন করে সেতু নির্মাণের সুযোগ নেই। কেননা, সেতু হলে নদীতে পলি জমে চট্টগ্রাম বন্দর অচল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই এই সেতুর ২১ কিলোমিটার ভাটিতে কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে নদীর তলদেশে নির্মাণ করা হয়েছে টানেল। এটি শুধু শাহ আমানত সেতুর ওপর চাপ কমাবে না, আনোয়ারায় পরিকল্পিত শহর সম্প্রসারণের সুযোগ খুলে দিয়েছে। কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল চালু হবে ২০২৬ সালে। এই টার্মিনাল চালু হলে সারা দেশ থেকে পণ্য আনা–নেওয়া করা যাবে টানেল দিয়ে।

ঢাকা থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারগামী গাড়ি এখন চট্টগ্রাম শহরে না ঢুকে ফৌজদারহাটে টোল রোড এবং চট্টগ্রামের সাগরপাড়ে আউটার রিং রোড হয়ে সরাসরি টানেলের মাধ্যমে আনোয়ারায় চলে যাবে। একইভাবে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী গাড়ি একই পথে যেতে পারবে। এতে অন্তত ৪০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে।

বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, টানেলের মাধ্যমে সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম–কক্সবাজারের যোগাযোগ আরও সহজ হলো। এখন দক্ষিণ চট্টগ্রামে পরিকল্পিতভাবে নতুন শহর ও নতুন নতুন শিল্প এলাকা গড়ে তোলা যাবে।

যেভাবে এগিয়েছে টানেল

২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। তৎকালীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) এই প্রকল্প অনুমোদন পায়। এরপর ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্মাণকাজ শুরু করে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। সাড়ে চার বছরের নির্মাণযজ্ঞ শেষে আজ উদ্বোধন হচ্ছে এই টানেল। টানেল নির্মাণে মূল প্রকল্প ব্যয় ছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। দুই দফা প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে ৪ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। চীন সরকারের অর্থসহায়তা ছিল ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা।

টানেলের ভেতরে থাকা দুটি টিউব বা সুড়ঙ্গের প্রতিটি ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার লম্বা। গাড়ি চলাচলের জন্য প্রতিটি টিউবে দুটি করে লেন রয়েছে। সংযোগ সড়কসহ টানেলের মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে প্রথম টানেল নির্মাণ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। দেশি–বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নির্দিষ্ট সময়ে নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব হয়েছে।

টেমস টানেল হলো নদীর তলদেশে বিশ্বের প্রথম টানেল। যুক্তরাজ্যের টেমস নদীর তলদেশে ১৮৪৩ সালে এই টানেল চালু হয়। গত এপ্রিলে ভারতের হুগলী নদীর তলদেশে ৫২০ মিটার লম্বা রেল টানেল পরীক্ষামূলক চালু হয়। সড়ক টানেল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় সে অর্থে প্রথম টানেল বঙ্গবন্ধু টানেল। বিশ্বে নদীর তলদেশে ২০০টির মতো টানেল রয়েছে।

দুয়ার খুলছে নতুন অর্থনৈতিক হাবের

টানেলের তাৎক্ষণিক সুফলের চেয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাই বড় করে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা। এর কারণ দুটি। এক. আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মাতারবাড়ী পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি পরিকল্পিতভাবে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা যাবে, যেখান থেকে খুব সহজেই টানেল ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আনা–নেওয়া করা যাবে। আবার ২০২৬ সালে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল চালু হলে সারা দেশের পণ্য এই টানেল ব্যবহার করে আনা–নেওয়া সহজ হয়ে যাবে।

দুই. শিল্পকারখানা চালুর জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের মতো সুবিধা দেওয়া যাবে এই অঞ্চলে, এ জন্য বাড়তি খুব বেশি বিনিয়োগ করতে হবে না। কারণ, আমদানি গ্যাসের পাইপলাইন নেওয়া হয়েছে এই অঞ্চল দিয়ে। চালু ও চালুর অপেক্ষায় থাকা আড়াই হাজার মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও রয়েছে এ অঞ্চলে। অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সব সুবিধা রয়েছে এই অঞ্চলে।

এই টানেল মূলত মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সমুদ্র উপকূলের সঙ্গে আনোয়ারা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত উপকূলকে যুক্ত করেছে। এই উপকূলে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। বৈদেশিক ঋণসহায়তার জন্য প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প ছক তৈরি হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ১৭০ কিলোমিটার লম্বা মেরিন ড্রাইভ নির্মাণে সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।

উদ্যোক্তারা বলছেন, এই মেরিন ড্রাইভের পাশে গুচ্ছ গুচ্ছ শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা যাবে। শিল্পাঞ্চল গড়ার জন্য জমিরও সহজলভ্যতা রয়েছে। যেখানে খাসজমিই বেশি।

প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এই অঞ্চলে শিল্পায়নে গতি আনবে টানেল। কারণ, কাছাকাছি বন্দর–সুবিধা থাকায় ব্যবসার খরচ কমবে। আবার সুপরিকল্পিতভাবে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা যাবে।

অর্থনীতিবিদ ও ইউজিসির সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সাগর উপকূল ধরে বিশাল এলাকা শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এই সুবিধা নিতে হলে মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সাগর উপকূল ধরে মেরিন ড্রাইভ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। আবার বাংলাদেশ–চীন–ভারত–মিয়ানমার অর্থাৎ বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরের সড়ক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই টানেল। বিসিআইএম কার্যকর হলে সত্যিকার অর্থে আগামী দিনে অর্থনৈতিক হাবে পরিণত হতে পারে এ অঞ্চল।