নুরনবী ওরফে সাকিব
নুরনবী ওরফে সাকিব

কেবল পুলিশ নয়, সোর্সকে টাকা দেয় চোরও

অপরাধী গ্রেপ্তার কিংবা মাদকসহ অবৈধ মালামাল উদ্ধারে সাধারণত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘সোর্স মানি’ (তথ্যদাতাকে দেওয়া টাকা) দিয়ে থাকে। কিন্তু চট্টগ্রামে ধরা পড়া চোর দলের এক নেতাও পুলিশের মতো তথ্যদাতাকে ‘সোর্স মানি’ দিয়ে থাকেন। এ জন্য চুরির টাকাকে তিন ভাগ করেন তিনি। এক ভাগ দেন ‘সোর্স’ অর্থাৎ তথ্যদাতাকে, আরেক ভাগ মামলার খরচ এবং বাকিগুলো নিজের ও পরিবারের জন্য রাখেন। নুরনবী ওরফে সাকিব (২৩) নামের এক পেশাদার চোরকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ এসব তথ্য জানতে পারে। নুরনবীর বিরুদ্ধে নগরের বিভিন্ন থানায় চুরির ছয়টি মামলা রয়েছে। এ পর্যন্ত তিনি আড়াই শ চুরির নেতৃত্বে দেন। তাঁর রয়েছে ২৫ জনের একটি দলও।

গত ১৩ জুন ঢাকা ও কুমিল্লায় অভিযান চালিয়ে নুরনবী ও তাঁর এক সহযোগী আশিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। নগরের ডবলমুরিং থানা এলাকায় এক দম্পতির বাসায় রাখা ১৮ লাখ টাকা ও ২৩ ভরি স্বর্ণালংকার চুরির ঘটনায় করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাঁদের গ্রেপ্তার করে। তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় সাড়ে ১৩ ভরি স্বর্ণালংকার ও ২ লাখ টাকা।

চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) মো. আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টার্গেট করা বাসার আশপাশে সোর্সের মাধ্যমে খোঁজ নেন। যেসব বাসায় কেউ থাকে না, সেসব বাসা বেছে নেন তাঁরা। পরে এটির আশপাশে ঘোরাফেরা (রেকি) করেন। সুযোগ বুঝে রাতের বেলা বাসার গ্রিল কেটে চুরি করেন নুরনবী ও তাঁর সহযোগীরা।

গ্রেপ্তারের পর নুরনবীর কাছ থেকে পাওয়া যায় অবাক করা তথ্য। পুলিশ কর্মকর্তা আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চুরির টাকা তিন ভাগ করেন নুরনবী। এক ভাগ দেন সোর্সকে। আরেক ভাগ রাখেন মামলার খরচের জন্য। বাকি টাকা রাখেন নিজের ও পরিবারের জন্য।

সোর্সকে কেন টাকা দেন, সে বিষয়ে নুরনবী পুলিশকে জানান, প্রথমত সোর্স তাঁকে তথ্য দেন, কোন বাসায় চুরি করা যাবে। বাসার কোন দিকে ঢুকে সহজে বের হওয়া যাবে। এ ছাড়া এসব সোর্স চুরির সময় তাঁদের নানাভাবে সহযোগিতা দেন। বিভিন্ন এলাকায় চুরি করতে করতে সোর্সদের সঙ্গে নুরনবীর সখ্য গড়ে ওঠে।

কত টাকা সোর্স মানি নুরনবী দিয়ে থাকেন—এ প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ কর্মকর্তা আলী হোসেন জানান, তা নির্দিষ্ট করা নেই। মালামাল বেশি পেলে বেশি দিয়ে থাকেন। ১০ হাজার টাকার মালামাল চুরি করলে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা সোর্সকে দিয়ে দেন।

নগরের আগ্রাবাদ, পাহাড়তলী, আকবরশাহ, সদরঘাট ও বন্দর এলাকায় চুরির ঘটনায় বেশির ভাগই নুরনবী ও তাঁর দল জড়িত। তাঁরা একেকজন আট থেকে নয়বার গ্রেপ্তার হয়েছেন। জামিন নিয়ে বের হয়ে আবার চুরি করেন। চুরির টাকায় তাঁরা আগের মামলার খরচ চালান।

পুলিশ জানায়, নগরের সদরঘাট এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে নুরনবী সাকিব। তাঁরা দুই ভাই ও দুই বোন। নগরের সিআরবি এলাকার বস্তিতে নুরনবীর জন্ম। ১২ বছর বয়সেই চুরির মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ করেন তিনি। মো. মেহেদী ও মো. মনির নামের দুই চোরের মাধ্যমে এ জগতে পা বাড়ান নুরনবী। দুজনের বিরুদ্ধে ৩০টি করে চুরির মামলা রয়েছে।

নুরনবী ১৬ বছর বয়সেই হয়ে যান দুর্ধর্ষ চোর। গড়ে তোলেন নিজের দল। তাঁর দলে ২০ থেকে ২৫ জন সদস্য রয়েছে। এ পর্যন্ত আড়াই শ চুরির নেতৃত্ব দেন তিনি। চুরির পর কুমিল্লা কিংবা ঢাকায় চলে যান। বদলে ফেলেন মুঠোফোন ও সিম। যার কারণে সহজে পুলিশ তাঁর অবস্থান শনাক্ত করতে পারেন না। আর মালামালগুলো বিক্রি করেন কয়েক ভাগ করে, যাতে সহজে ধরা না পড়েন।

নুরনবী বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তাঁর বড় ভাই ট্রাকচালক মো. মামুন প্রথম আলোকে বলেন, অভাবের সংসার। তাঁর ভাই পড়ালেখা করতে পারেননি। বন্ধুদের সঙ্গে মিশে চুরিতে জড়িয়ে পড়েন।

নুরনবী ও তাঁর সহযোগীকে এক দিনের রিমান্ডে এনে গতকাল মঙ্গলবার জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁরা পুলিশকে জানান, আর কিছু করতে পারেন না, তাই চুরি করেন। চুরির কাজ ছেড়ে দিতে কেউ কখনো বলেননি তাঁদের।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মো. আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারের পর জামিনে বেরিয়ে আবার চুরি করেন তাঁরা। নতুন করে যাতে তাঁরা চুরিতে জড়িয়ে না পড়েন, এ বিষয়ে পরিবার, স্বজন ও সংশ্লিষ্ট সবার এগিয়ে আসা উচিত। প্রয়োজনে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কোনো কাজে যুক্ত করে দিতে হবে, যাতে চুরিতে আর না জড়ান।