আহমদ মরতুজা চৌধুরী পেশায় চিকিৎসক। স্ত্রী হাসনে আরা বেগম অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ১৯৯০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁদের বিয়ে হয়। প্রায় ৩৩ বছরের দাম্পত্য জীবনে তাঁরা বহুবার একসঙ্গে রক্ত দান করেছেন। শুরুতে বিবাহবার্ষিকীর দিনটিকে তাঁরা রক্তদানের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, নিজেদের বিশেষ দিনটিতে কারও উপকারে আসা। পরে দুজনে নিজেদের জন্মদিনেও কয়েকবার রক্ত দান করেন।
আহমদ মরতুজা চৌধুরী ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। এখন কর্মরত আছেন রাজধানীর ডা. এম আর খান শিশু হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথে। হাসনে আরা বেগম রাজধানীর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।
মরতুজা চৌধুরী ও হাসনে আরা দম্পতির মতো করে অন্যের উপকার করার উদ্দেশ্য নিয়ে রক্ত দান করে যাচ্ছেন আনোয়ারা বেগম। পেশায় নার্স এই নারী এ পর্যন্ত অন্তত ৭০ বার রক্ত দান করেছেন।
আজ ১৪ জুন (বুধবার) বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘রক্ত দিন, প্লাজমা দিন, অপরের সহায়তায় জীবন ভাগাভাগি করুন’। রক্তের অভাবে যেন কাউকে ভুগতে না হয় এবং দুঃসময়ের জন্য রক্ত সঞ্চয় করার আহ্বান জানিয়ে রক্তদানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে দিবসটি পালন করা হয়।
গত শনিবার (১০ জুন) প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে আহমদ মরতুজা চৌধুরী (৬৬) ও হাসনে আরা বেগম (৬৪) নিজেদের রক্তদানের গল্প শোনান।
১৯৮১ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় সন্ধানীতে প্রথম রক্ত দান করেন অধ্যাপক আহমদ মরতুজা চৌধুরী। স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির অগ্রগামী সংগঠন স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত সন্ধানীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ইদ্রিস আলী ছিলেন তাঁর বন্ধু। বিয়ের ১০ বছর পর ২০০০ সাল থেকে মরতুজা চৌধুরী ও হাসনে আরা বেগম একসঙ্গে রক্ত দান করা শুরু করেন। নিজেদের বিবাহবার্ষিকীর দিনটিতে রক্ত দান করতেন তাঁরা। পরে এ দম্পতি নিজেদের জন্মদিনেও একসঙ্গে রক্ত দেওয়া শুরু করেন। আহমদ মরতুজা চৌধুরীর জন্মদিন ২৬ অক্টোবর, স্ত্রীর ১৭ জুলাই।
তবে সব সময় মরতুজা চৌধুরী ও হাসনে আরার পক্ষে বিশেষ দিন বা নির্দিষ্ট তারিখ মেনে চলা সম্ভব হতো না। কারও রক্তের প্রয়োজন হলেই তাঁরা ছুটে যেতেন। মরতুজা চৌধুরীর রক্তের গ্রুপ ‘বি’ পজিটিভ আর হাসনে আরা বেগমের ‘এ’ পজিটিভ।
ঠিক কতটি বিবাহবার্ষিকীতে তাঁরা রক্ত দান করেছেন, জানতে চাইলে অধ্যাপক মরতুজা বলেন, ‘সে সংখ্যার হিসাব নেই। তবে ২০০০ সাল থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে আমরা একসঙ্গে ৩৮ বার রক্ত দিতে গিয়েছি। এর মধ্যে কয়েকবার আমার স্ত্রী রক্ত দান করতে পারেননি। রক্ত পরীক্ষায় তাঁর হিমোগ্লোবিন কম এসেছিল। এ কারণে কয়েকবার আমাকে একাই রক্ত দিতে হয়েছে। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক করে আমার স্ত্রী পরে গিয়ে রক্ত দিয়েছেন।’
২০০০ সাল থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে আমরা একসঙ্গে ৩৮ বার রক্ত দিতে গিয়েছি। এর মধ্যে কয়েকবার আমার স্ত্রী রক্ত দান করতে পারেননি। রক্ত পরীক্ষায় তাঁর হিমোগ্লোবিন কম এসেছিল। ফলে কয়েকবার আমাকে একাই রক্ত দিতে হয়েছে। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক করে আমার স্ত্রী পরে গিয়ে রক্ত দিয়েছেন।আহমদ মরতুজা চৌধুরী, অধ্যাপক, ডা. এম আর খান শিশু হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ
৬০ বছর বয়স (১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী ব্যক্তিদের রক্ত নেওয়া হয়) পর্যন্ত তাঁরা রক্ত দিয়েছেন বলে জানান অধ্যাপক মরতুজা চৌধুরী। তিনি বলেন, চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে তিনি জানেন, রক্ত দান করার উপকারিতাই বেশি। রক্তের লোহিত কণিকা ৯০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে মরে যায়। এই নির্দিষ্ট সময় পর রক্তের কোষগুলো মরে গিয়ে নতুন করে তৈরি হয়। রক্ত দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রক্তের জলীয় অংশটা পূরণ হয়ে যায়, পুরোপুরি পূরণ হয় তিন থেকে চার মাসের মধ্যে।
অধ্যাপক মরতুজা আরও বলেন, তিন থেকে চার মাস পরপর নিয়মিত রক্ত দিলে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমে। দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক থাকে। সবচেয়ে বড় কথা, রক্তদানের কারণে অপর একজন মানুষের জীবন বাঁচে।
‘কারও জন্য কিছু করতে পারছি’—এ ভাবনা তাঁদের রক্তদানের জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক হাসনে আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মোট ৩৯ বার রক্ত দিয়েছেন।
এই দম্পতি থাকেন রাজধানীর পুরানা পল্টনে। তাঁদের দুই ছেলে। রক্তদানের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মরতুজা-হাসনে আরা দম্পতি জানান, একবারের একটি ঘটনা তাঁদের বেশ আনন্দ দিয়েছিল। ২০১০ সালে কালাজ্বরে আক্রান্ত পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া একটি মেয়ে খুব অসুস্থ ছিল। ওই সময় হাসনে আরা বেগম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মেয়েটিকে রক্ত দেন। সেই মেয়ে কয়েক বছর পর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে মিষ্টি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, দেশে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ ব্যাগ রক্ত ও রক্তের উপাদানের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে কোয়ান্টাম বছরে এক লাখের বেশি ব্যাগ সরবরাহ করে। একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর প্রতি মাসে ১ থেকে ৩ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। দেশে প্রায় ৮০ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছে।
২০০০ সালে আনোয়ারা বেগম (৪১) নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। রোগীদের কষ্ট দেখতেন, সংকটাপন্ন রোগীদের রক্ত জোগাড়ে স্বজনদের ছুটতে দেখতেন। তখন থেকে মনে হতো, সেবা দেওয়ার পাশাপাশি রক্ত দান করে একটি মানুষের পাশে থাকা যায়। তাঁর রক্তের গ্রুপ ‘এবি’ পজিটিভ। এখন তিনি রাজধানীর অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে নার্স হিসেবে কর্মরত। মা–বাবা আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পুরান ঢাকায় থাকেন।
আনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ২০০১ সালে একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করা অবস্থায় হাসপাতালের পরিচালকের ডেঙ্গু আক্রান্ত এক আত্মীয়কে প্রথমবার রক্ত দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ব্যাপক হতাহত হওয়ার ঘটনায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে গিয়ে তিনি রক্ত দান করেন।
রক্ত দিতে অনেকে ভয় পান উল্লেখ করে আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই। নিয়মিত রক্তদানের কারণে আমি সুস্থ বোধ করি। আমার সব সময় মনে হয়, এখন আমি অন্যের প্রয়োজনে রক্ত দিচ্ছি, আমার দরকারেও অন্য কেউ এসে রক্ত দেবে।’
কোয়ান্টাম ল্যাবের সংগঠক শামীমা নাসরিন প্রথম আলোকে বলেন, নার্স আনোয়ারা বেগম ২০০৩ সাল থেকে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত ৫০ বার শুধু কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে রক্ত দান করেছেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে ৫০ বার বা এর বেশি রক্তদান করা ৮৩ জনের মধ্যে আনোয়ারা বেগমসহ দুজন নারী রয়েছেন। অপরজন হলেন রোকসানা বিলকিস (৫৬)।
শামীমা নাসরিন বলেন, তাঁদের সংগঠনে আহমেদ মরতুজা চৌধুরী ও হাসনে আরা বেগম দম্পতি ৩৮ বার রক্ত দিয়েছেন। এই দম্পতি বিবাহবার্ষিকীর দিন রক্ত দিতে আসতেন। তিনি বলেন, দেশে রক্তের চাহিদার তুলনায় ঘাটতি রয়েছে। তাই আরও বেশিসংখ্যক মানুষের নিয়মিত রক্তদানে এগিয়ে আসা উচিত।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, দেশে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ ব্যাগ রক্ত ও রক্তের উপাদানের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে কোয়ান্টাম বছরে এক লাখের বেশি ব্যাগ সরবরাহ করে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত একজন রোগীর প্রতি মাসে ১ থেকে ৩ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। দেশে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী রয়েছে প্রায় ৮০ হাজার।