জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভবন
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভবন

রাজস্ব আদায়ে অগ্রগতি নেই, ৭ ভবন নির্মাণের তোড়জোড়

বাংলাদেশে কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। কর আদায় না বাড়িয়ে বহুতল ভবন নির্মাণে মনোযোগ এনবিআরের।

দেশের তিন বিভাগীয় শহর ও চার জেলা শহরে বহুতল কর ভবন করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই ৭টি ভবন নির্মাণে ব্যয় হবে ৫৬৮ কোটি টাকা। তাদের যুক্তি, ভবন নির্মিত হলে ওইসব এলাকায় রাজস্ব আদায় বাড়বে। অথচ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর মতে, গত দুই দশকে বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।

তিন বিভাগ ও চার জেলা শহরে সাতটি ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য গত মাসে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে এনবিআর। একটি প্রকল্পের নাম ‘৩টি বিভাগীয় শহর ও তিনটি জেলা সদরে ভবন নির্মাণ’। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৫৩২ কোটি টাকা। অন্য প্রকল্পটির নাম ‘সিরাজগঞ্জ কর ভবন নির্মাণ’। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩৬ কোটি টাকা। দুই প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ৫৬৮ কোটি টাকা।
তবে এনবিআরের বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। বলেছে, বিভাগ ও জেলা শহরে বহুতল ভবন কতটা দরকার, আগে তা দেখতে হবে। তা ছাড়া কর ভবন নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত সাতটি শহরই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়। আছে জলাবদ্ধতার সমস্যাও। কী পরিমাণ কর্মকর্তার জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে, তা–ও প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি। এনবিআরের কাছে এসব বিষয়ের পাশাপাশি কিসের ভিত্তিতে সাতটি বিভাগ ও জেলা বাছাই করা হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্য অনুযায়ী, দুই দশক ধরে বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত ভালো নয়। এখনো এই অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সবচেয়ে কম।

  • সিলেট, বরিশাল, রংপুর বিভাগসহ আরও চার জেলায় ভবন নির্মাণের প্রস্তাব

  • ৭টি ভবন বানাতে মোট ব্যয় ধরা হয় ৫৬৮ কোটি টাকা

  • এনবিআরের প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে দেশে কর আদায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। জিডিপির আকার যেভাবে বাড়ছে, রাজস্ব আদায় সেভাবে বাড়ছে না। জিডিপির তুলনায় কর আদায়ে বিশ্বে যেসব দেশ সবচেয়ে পিছিয়ে, বাংলাদেশ তার একটি। অথচ কর আদায় বৃদ্ধির উদ্যোগ না নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করতে চাচ্ছে এনবিআর।

এনবিআরের প্রস্তাব

বিভাগীয় শহর সিলেট, বরিশাল ও রংপুর এবং দিনাজপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিরাজগঞ্জ জেলা শহরে কর ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বরিশালে দশম তলা, রংপুর ও সিলেটে নবম তলা, নোয়াখালীতে অষ্টম তলা ভবন করতে চায় এনবিআর। এ ছাড়া দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জে সাততলা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছয়তলা ভবনের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি সাতটি শহরেই ডরমিটরি ভবন করা হবে।
সাতটি কর ভবন নির্মাণের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে এনবিআর বলছে, সরকারের ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির বিকল্প নেই। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দাপ্তরিক স্থান সংকুলান বড় ধরনের সমস্যা। করদাতাদের ভালো সেবা দিতে নতুন সাতটি কর ভবন নির্মাণ জরুরি।

দেশে রাজস্ব আদায়ের হার না বাড়িয়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণে মনোযোগ দিচ্ছে এনবিআর। এখানে কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের স্বার্থের বিষয় জড়িত থাকে
—জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিভাগ ও জেলা শহরে তাদের স্থাপনা হলে কর আদায় বাড়বে। কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে কর বিভাগের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা ও কাজের মান বাড়বে।

ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুটি প্রকল্প তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত এনবিআরের কর অঞ্চল-৬–এর কর কমিশনার লুৎফুল আজীম প্রথম আলোকে বলেন, সাতটি শহরে এনবিআরের নিজস্ব জমি আছে। অন্য কোথাও স্থাপনা করতে গেলে জমি অধিগ্রহণে অনেক সময় চলে যাবে। খরচও বাড়বে। তিনি বলেন, ‘কর ভবন করা হলে রাজস্ব আদায় বাড়বে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বহুতল ভবনের প্রস্তাব কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই সব এলাকায় এরই মধ্যে বহুতল ভবন হয়েছে। তবু পরিকল্পনা কমিশন কেন এ প্রশ্ন তুলছে, তা আমাদের জানা নেই।’

পরিকল্পনা কমিশনের মতামত

দুই প্রকল্পের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, নির্বাচিত তিন বিভাগ ও চার জেলা শহরে বহুতল ভবন কতটা প্রয়োজন, তা যাচাই-বাছাই করতে হবে। প্রতিটি ভবনে কত কর্মকর্তা বসবেন, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। বিভাগ ও জেলা শহরে ডরমিটরি ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। রাজস্ব আদায় বাড়াতে, নাকি অন্য কোনো দিক বিবেচনায় এই সাতটি বিভাগ ও জেলা বাছাই করা হয়েছে, তা-ও জানতে চায় কমিশন।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, দেশে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামে। ঢাকায় কর অঞ্চল আছে ১৫টি। সব অফিস চলছে ভাড়া বাড়িতে। বরিশাল, নোয়াখালী ও সিরাজগঞ্জে উল্লেখযোগ্য শিল্পায়ন নেই। এসব এলাকা থেকে কর আদায়ের হারও ভালো নয়।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে রাজস্ব আদায়ের হার না বাড়িয়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণে মনোযোগ দিচ্ছে এনবিআর। এখানে কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের স্বার্থের বিষয় জড়িত থাকে। ভবনের অভাবে দেশে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না, এমন কথা কখনো শুনিনি। ভবন করলে কি দেশে রাজস্ব আদায় বেড়ে যাবে? কর জাল বাড়বে? কর ফাঁকি রোধ হবে? এনবিআরকে এসব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। নতুন ভবন নির্মাণের চেয়ে এনবিআরকে কর জাল বাড়ানোর তাগিদ দেন এই অর্থনীতিবিদ।