বাল্যবিবাহে স্কুল বন্ধ অনেক কিশোরীর

দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সময়ের অঙ্গীকার, কন্যাশিশুর অধিকার’। সরকারিভাবে দিবসটি ৪ অক্টোবর পালিত হবে।

বাল্যবিবাহ ঠেকানোর লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির মেয়েদের জন্য ‘কিশোরী সংঘ’ চালু করেছে সরকার। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ১৪ বছরের মেয়েটি ওই সংঘের সদস্য ছিল। তবে এতেও ঠেকানো যায়নি তার বাল্যবিবাহ। চলতি বছরের এপ্রিলে কিশোরীটিকে বিয়ে দিয়েছেন অভিভাবকেরা। সে আর বিদ্যালয়ে ফেরেনি।

মেয়েটির মা গত রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েকে তার স্বামী আর পড়াতে চায় না। বিয়ে দেওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মেয়ের যেটা মন চায়, সেটা করে। এ জন্যই বিয়ে দিয়ে দিছি।’ বিয়ের পর ‘যেটা মন চায়, সেটা করা’ বন্ধ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘এখনো পুরা ঠিক হয়নি।’

একই বিদ্যালয়ের কিশোরী সংঘের আরেক সদস্য সপ্তম শ্রেণির মেয়েটিরও (১৩) প্রায় একই সময়ে বিয়ে হয়েছে। তারও আর পড়ালেখায় ফেরা হয়নি।

কোনো কারণে তালাকের প্রয়োজন হলে সালিসের মাধ্যমে হতে হয়। মেয়েটির কোনো আইনি অধিকারও থাকে না।
নাজমুন নাহার, বাল্যবিবাহগুলো নিবন্ধন হয় না উল্লেখ করে সাতক্ষীরার তালা উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা

পড়ালেখার মাধ্যমে একটি মেয়ের বেড়ে ওঠার অধিকারের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা হয় বাল্যবিবাহকে। বাল্যবিবাহের এমন পটভূমিতে ‘সময়ের অঙ্গীকার, কন্যাশিশুর অধিকার’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ ৩০ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। এবার সরকারিভাবে দিবসটি ৪ অক্টোবর পালিত হবে। আর ৩ থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত পালন করা হবে শিশু অধিকার সপ্তাহ।

করোনাকালে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের ‘দরিদ্র মহিলাদের জন্য সমন্বিত কর্মসংস্থান সহায়তা’ প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) আওতায় এ বছরের ৩১ মার্চ থেকে ‘কিশোরী সংঘ’ চালু করা হয়। পাইলট প্রকল্প হিসেবে ১৫টি জেলার ৫৯টি উপজেলার ১১৮টি স্কুলে পাঁচ বছরের জন্য এ সংঘ চালু করা হয়েছে। একটি স্কুল থেকে ১০০টি মেয়েকে সংঘের সদস্য করা হয়।

এ সংঘের সদস্য মেয়েদের অভিভাবকেরা তাঁদের মেয়েদের জন্য মাসে ২০০ টাকা করে সেখানে জমা দেন। সরকার তার সঙ্গে আরও ২০০ টাকা যোগ করে। পরে ৪০০ টাকা অভিভাবকদের দেওয়া হয়।

সাতক্ষীরার চার উপজেলার আটটি স্কুলে ‘কিশোরী সংঘ’ রয়েছে। জেলাটির সদর উপজেলার দায়িত্বে থাকা সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মৃদুল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার অনেক উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু অভিভাবকেরা সচেতন না হলে বাল্যবিবাহ ঠেকানো কঠিন।’

থেমে নেই বাল্যবিবাহ

১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ‘বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বাল্যবিবাহ’ শিরোনামে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ ও ২০২১ করোনা মহামারির দুই বছরে বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের ৭৬ শতাংশ আর বিদ্যালয়ে ফেরেনি।

করোনা মহামারির দুই বছরে ১৫-১৯ বছর বয়সী ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর ও চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২০ জেলায় ২ হাজার ৮২০ মেয়ের ওপর জরিপটি পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২১ সালে ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। ওই ছাত্রীরা গত বছর বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।

পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে শ্বশুরবাড়ি

কুষ্টিয়া সদরের বাল্যবিবাহের শিকার এক মেয়ের মা বলেন, এ বছর মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা আর পড়াশোনা করাবে না।

একই এলাকার বাল্যবিবাহ হওয়া আরেক মেয়ের মা প্রথম আলোকে জানান, এখন শ্বশুরবাড়ি চায় না মেয়ে আর বিদ্যালয়ে যাক।

বিয়ের সময় তাঁর স্ত্রী নবম শ্রেণিতে পড়ত উল্লেখ করে জেলার কুমারখালী উপজেলার এক ব্যক্তি জানালেন, তিনি স্ত্রীকে আর বিদ্যালয়ে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ওপরে উল্লেখ করা কিশোরীরা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপে অংশ নিয়েছিল। সংস্থাটির হয়ে জরিপ করা স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা মুক্তি নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার কর্মসূচি সমন্বয়ক শেখ জায়েদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দুই ধাপে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত জরিপে পাঁচটি বিদ্যালয় থেকে ৪২২ ছাত্রীর ঝরে পড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৬২টি বাল্যবিবাহ।  

‘বাল্যবিবাহের হার কমছে’

বাল্যবিবাহগুলো নিবন্ধন হয় না উল্লেখ করে সাতক্ষীরার তালা উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কারণে তালাকের প্রয়োজন হলে সালিসের মাধ্যমে হতে হয়। মেয়েটির কোনো আইনি অধিকারও থাকে না।

সাতক্ষীরার বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে গড়া বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির প্রশাসনিক প্রধান মো. সাকিবুর রহমান মনে করেন, বাল্যবিবাহ বন্ধে স্থানীয় বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটিকে সক্রিয় করতে হবে।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার নানা কর্মসূচি ও হেল্পলাইন নম্বর (১০৯) চালু আছে জানিয়ে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কাছে এখন যে তথ্য রয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে বাল্যবিবাহের হার কমে আসছে। কোনো কোনো উপজেলা বাল্যবিবাহমুক্তও হয়েছে।