শ্রম আদালতে শিরিন, মিলনাদের মামলা ঝুলছে বছরের পর বছর

কোনো কোনো মামলা অনিষ্পন্ন ১০ বছর ধরে। কোনো ক্ষেত্রে বাদী শ্রমিক মারাও গেছেন।

দেশের শ্রম আদালতগুলোতে ২১ হাজার ৬১৭টি মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ মামলা নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি হয়নি। কোনো কোনো মামলা ঝুলছে ১০ বছর ধরে।

যেমন মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে ২০১৪ সালে চাকরিচ্যুত হন ঢাকার খিলক্ষেতের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক শিরিন আক্তার (৩৫)। ওই বছরই তিনিসহ ১৯ জন কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে পাওনার দাবিতে ঢাকার শ্রম আদালতে মামলা করেন। এত বছরেও সেই মামলা নিষ্পত্তি হয়নি।

শ্রম আদালতে দুই দশক ধরে ঝুলে আছে, এমন মামলাও রয়েছে। অনেক মামলার নথি খুঁজে পেতেও এখন কষ্ট হয়।
সেলিম আহসান খান, আইনজীবী

শিরিন আক্তার এখন গাজীপুরে থাকেন। ৪ জানুয়ারি মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে তাঁর অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে। এখন তিনি অসুস্থ, হাড়ক্ষয় রোগে ভুগছেন। তাই সর্বশেষ ৪ মাসে আদালতে যাননি। তাঁরা যে ১৯ জন মামলা করেছিলেন, কারও মামলাই নিষ্পত্তি হয়নি। একজন মারাও গেছেন।

ঢাকাসহ দেশের ১০টি জেলায় ১৪টি শ্রম আদালত রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে চারটি (আপিল ট্রাইব্যুনালসহ)। চাকরিচ্যুতি, পাওনা, ক্ষতিপূরণ না পাওয়াসহ নানাভাবে বঞ্চিত ভুক্তভোগীরা শ্রম আইন প্রতিকার চেয়ে শ্রম আদালতে মামলা করতে পারেন।

শ্রম আইনে বলা আছে, শ্রম আদালতের রায়, সিদ্ধান্ত বা রোয়েদাদ, প্রত্যেক ক্ষেত্রে মামলা দায়ের করার তারিখ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে প্রদান করতে হবে। ৬০ দিনের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে রায় দেওয়া সম্ভব না হলে উপযুক্ত কারণ লিপিবদ্ধ করে আদালত সময়সীমা আরও ৯০ দিন বাড়াতে পারবেন।

গত এক থেকে দেড় বছরে শ্রম আদালতের সংখ্যা ৭টি বাড়িয়ে ১৪টি করা হয়েছে। দরকার হলে আরও বাড়ানো হবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক

শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের শ্রম আদালতগুলোতে যে ২১ হাজার ৬১৭টি মামলা ছিল, তার মধ্যে ১৬ হাজার ১৪১টি মামলা ছয় মাসের বেশি সময় অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৭৫ শতাংশ মামলাই আইনে নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি হয়নি। শ্রম আদালতে ক্ষতিপূরণ ও পাওনা আদায়ের জন্য দায়ের করা মামলার ৯০ শতাংশই পোশাকশ্রমিকদের করা।

শ্রম আদালতে মামলা পরিচালনা করা দুজন আইনজীবী বলছেন, বছরের পর বছর ঝুলতে থাকে বলে একসময় শ্রমিকেরা মামলা চালাতে অনাগ্রহ দেখান।

আইনজীবী কফিল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বছরের পর বছর ধরে ক্ষতিপূরণের মামলা নিষ্পত্তি হয়নি, কিন্তু শ্রমিক মারা গেছেন, এমন তিনটি ঘটনা তিনি জানেন। এই তিন ঘটনায় দুজন শ্রমিক মারা যাওয়ার পর তাঁদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। মারা যাওয়া এক শ্রমিকের পরিবার এখন আর মামলা চালাতে চায় না।

আরেক আইনজীবী সেলিম আহসান খান বলেন, শ্রম আদালতে দুই দশক ধরে ঝুলে আছে, এমন মামলাও রয়েছে। অনেক মামলার নথি খুঁজে পেতেও এখন কষ্ট হয়।

শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের শ্রম আদালতগুলোতে যে ২১ হাজার ৬১৭টি মামলা ছিল, তার মধ্যে ১৬ হাজার ১৪১টি মামলা ছয় মাসের বেশি সময় অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে।

মামলা কেন ঝুলে থাকে

শ্রম আদালতে মামলা ঝুলে থাকার কারণ নিয়ে আইনজীবী, শ্রমিকনেতা, ভুক্তভোগী ও আদালত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে তিনটি বড় কারণ জানা গেছে। প্রথমত, মামলার তুলনায় আদালতের সংখ্যা কম। দ্বিতীয়ত, মামলা নিষ্পত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি। তৃতীয়ত, বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আইনজীবীরা, বিশেষ করে মালিকপক্ষের আইনজীবীরা মামলা বিলম্বে নানা যুক্তি দাঁড় করান।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গত এক থেকে দেড় বছরে শ্রম আদালতের সংখ্যা ৭টি বাড়িয়ে ১৪টি করা হয়েছে। দরকার হলে আরও বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, মামলাজট কমাতে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

আদালত-সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, শ্রম আইনের ২১৩ ও ৩৩ ধারায় করা মামলাগুলোর ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগছে। এই দুই ধারায় করা মামলার শুনানিতে শ্রম আদালত গঠিত হয় একজন বিচারক এবং মালিক ও শ্রমিকপক্ষের একজন করে সদস্যের সমন্বয়ে। মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সদস্য শুধু মতামত দিতে পারেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রেই মালিকপক্ষ ও সরকারি দলের অনুসারী শ্রমিক সংগঠন থেকে নিয়োজিত সদস্যরা অনুপস্থিত থাকেন।

দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক বাদী শেষ পর্যন্ত মামলার খোঁজই নেন না। ফলে এসব মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। মালিকপক্ষ পার পেয়ে যায়, শ্রমিক আর প্রতিকার পান না।
লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সেলিম আহসান খান

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি ও শ্রম আদালতে শ্রমিকপক্ষের সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম আছে যে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সদস্য উপস্থিত হলে আদালত গঠিত হয়েছে বলে গণ্য হবে। কিন্তু মালিক ও সরকারি দলের অনুসারী শ্রমিক সংগঠনের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রেই বিচারকাজ বিলম্বিত হয়।

শ্রম আইনের ৩৩ নম্বর ধারায় লে অফ (কারখানা বন্ধ), ছাঁটাই, বরখাস্ত, অপসারণ বা অন্য কোনো কারণে অভিযোগ দায়েরের কথা বলা হয়েছে। ২১৩ নম্বর ধারায় স্বীকৃত কোনো অধিকার প্রয়োগ নিয়ে শ্রমিক সংগঠন, মালিক বা শ্রমিকের মামলার বিষয়ে বলা হয়েছে।

শ্রম আদালতে কাজ করা আইনজীবীদের সংগঠন লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সেলিম আহসান খান প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক বাদী শেষ পর্যন্ত মামলার খোঁজই নেন না। ফলে এসব মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। মালিকপক্ষ পার পেয়ে যায়, শ্রমিক আর প্রতিকার পান না।

নিষ্পত্তিতে লাগে গড়ে ৬০১ দিন

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) কর্মক্ষেত্রে আঘাত ও মৃত্যুর শিকার কর্মীদের পক্ষ থেকে শ্রম আদালতে দায়ের করা ৮০টি ক্ষতিপূরণ মামলা বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা প্রকাশ করে ২০২১ সালে।

 ‘টায়ার দেম আউট: চ্যালেঞ্জেস অব লিটিগেটিং কমপেনসেশন ক্লেইমস আন্ডার বাংলাদেশ লেবার অ্যাক্ট ২০০৬’ শীর্ষক এই গবেষণায় উঠে এসেছে, এসব মামলায় রায় দেওয়ার জন্য গড়ে ৬০১ দিন সময় লেগেছে। গবেষণাটিতে শ্রম আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি উঠে এসেছে। পাশাপাশি মামলার রায়ের পরও ক্ষতিপূরণ দিতে মালিকপক্ষের অস্বীকৃতি জানানোর বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে গবেষণায়।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মালিকেরা এতই শক্তিশালী যে তাঁদের আইনের আওতায় আনাই যায় না।

ঢাকায় বেশি মামলা ঝুলছে

ঢাকার শ্রম আদালতে মামলা বেশি। ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যাও সেখানে বেশি। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার তিনটি নিয়মিত শ্রম আদালতে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। গাজীপুরের আদালতে ছয় মাসের বেশি সময় ঝুলে আছে ৪ হাজার ৮৯২টি মামলা।

শ্রমিকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট মামলার বিষয়ে খোঁজ রাখেন শ্রমিকনেতা আশরাফুজ্জামান। তিনি এই প্রতিবেদককে ১৮টি মামলার তথ্য-উপাত্ত দিয়েছেন। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর ১১টি মামলা পাঁচ বছর ধরে ঝুলে আছে। ৭টি ঝুলছে দুই বছরের বেশি সময় ধরে।

আশরাফুজ্জামান যে ১৮টি মামলার তথ্য দিয়েছেন, তাঁর ১৪টির বাদীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা হতাশ। কেউ কেউ মামলার খোঁজ নেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছেন।

বাদীদের একজন আরিফুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১৩ বছর একটি প্রসাধন কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। চাকরি ছাড়ার পর তাঁর পাওনা ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার মধ্যে একটি পয়সাও দেয়নি মালিকপক্ষ। তিনি ২০২১ সালের নভেম্বরে ঢাকার শ্রম আদালতে মামলা করেন।

আরিফুর বলেন, মামলার শুনানির দিন ঠিক হয় দীর্ঘ বিরতিতে। ফলে মামলা এগোয় না। কবে রায় হবে, তা অনিশ্চিত।

শূন্য হাতে বিদায়

শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হলে তাঁকে তাঁর ‘সার্ভিস বেনিফিট’ (চাকরির মেয়াদ অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে অর্থ) ও ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। পাওনার পরিমাণ খুব একটা বেশি হয় না। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে যেসব মামলা আসে, তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাবির পরিমাণ এক লাখ টাকার আশপাশে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে শ্রমিকেরা যখন কারখানা থেকে চাকরি হারান, তাঁরা সেই সামান্য পাওনাটুকুও পান না। আদালতে গেলে বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েন।

শ্রম আদালতে ২০১৪ সালে মামলা করা পোশাকশ্রমিক মিলনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাওনা টাকা পাওয়ার আর আশা করি না।’