সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোয় বিস্ফোরণের ঘটনায় অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজ করার সময় গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি। সাত মাস চিকিৎসা নিতে হয়। তবু দমে যাননি। অতি সম্প্রতি সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায়ও উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন। সাহসী এই কর্মকর্তা হলেন সীতাকুণ্ডের কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কৃষ্ণ চন্দ্র দাস
প্রথম আলো: আপনার শারীরিক অবস্থা কেমন?
সুলতান মাহমুদ: শারীরিকভাবে ভালো আছি। ডান হাতে অপারেশনের কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় একটু কম জোর পাই। তবে কাজে কোনো অসুবিধা হয় না।
প্রথম আলো: ট্রমা কাটিয়ে এসেই আবার বিস্ফোরণের মুখোমুখি। এবারের ঘটনাটা কীভাবে দেখছেন?
সুলতান মাহমুদ: বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়ংকর দুর্ঘটনা ও ভয়াবহতা, হাসপাতালে আহত ব্যক্তি ও স্বজনদের আহজারি এখনো আমার কানে বাজে। আমি নিজেও সেদিনের দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছি। কিন্তু আহত অবস্থায় হাসপাতালের শয্যায় বারবার হতাহত মানুষ ও আমাদের সহকর্মীদের কথা ভেবেছি। তারপরও সেই ভয়াবহতা কাটতে না কাটতে আবার এই বিস্ফোরণ। তবে এবার আগের চেয়েও সতর্ক হয়েছি। মানুষের জীবন রক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছি।
প্রথম আলো: দুর্ঘটনার খবর কীভাবে পেয়েছেন? দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে কী দেখেছেন?
সুলতান মাহমুদ: দুর্ঘটনার সংবাদ স্থানীয় একজনের ফোনকলের মাধ্যমে পেয়েছি। বিস্ফোরণের খবর পাওয়ামাত্রই আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, আশপাশের সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বিস্ফোরণে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়েছে লোহার টুকরা। ট্রাক ও ভবনের আসবাবে বিক্ষিপ্তভাবে আগুন জ্বলছিল। কিছু আহত মানুষ গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে ছিল। অনেক মানুষ আহাজারি করছিল।
প্রথম আলো: দুর্ঘটনার খবরে প্রথমে কী মাথায় আসছিল?
সুলতান মাহমুদ: ফায়ার সার্ভিস স্টেশন থেকে গাড়িতে করে যখন দুর্ঘটনাস্থলে যাচ্ছিলাম, তখন আমার মুঠোফোনে একের পর এক ফোন আসতে থাকে। তাদের সঙ্গে কথা বলে ভয়াবহতা কেমন, তা বোঝার চেষ্টা করলাম। যেতে যেতে একটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করলাম। আমরা গিয়ে দুটি ভাগে ভাগ হব। জীবনহানি যাতে কম হয়, সে জন্য এক দল উদ্ধারকাজ করবে। অন্য দল অগ্নিনির্বাপণে কাজ করবে। সেই মতো অধীন কর্মীদের নির্দেশ দিলাম।
প্রথম আলো: শুরুতে কী কাজ করেছেন?
সুলতান মাহমুদ: কারখানায় প্রবেশের পর দেখলাম, সিলিন্ডার ও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা লোহার টুকরা উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে। আমাদের একটি দল আহত অবস্থায় পড়ে থাকা লোকদের উদ্ধারকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্য দল অগ্নিনির্বাপণে পানি ছিটানো শুরু করে। আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল, পড়ে থাকা সিলিন্ডারের নিচে আর কোনো হতাহত আছে কি না। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধারকে গুরুত্ব দিয়েই কাজ করেছিলাম।
প্রথম আলো: এবারের বিস্ফোরণে ভয়াবহতা কেমন ছিল?
সুলতান মাহমুদ: এবারের বিস্ফোরণে ভয়াবহতা ব্যাপক ও ভয়ানক ছিল। বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনের পর বিস্ফোরণ হয়েছিল। এবারের বিস্ফোরণের পর আগুন লেগেছে। এতে মানুষের ক্ষতির পাশাপাশি ভবনের চাল উড়ে গেছে। দেয়াল ফেটে গেছে। বিদ্যুতের লাইনের ক্ষতি হয়েছে।
প্রথম আলো: আপনার পরিবারে কে কে আছে?
সুলতান মাহমুদ: আমাদের দুই ছেলে, একটি মেয়ে।
প্রথম আলো: যখন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যান, তখন পরিবারের সদস্যদের মনোভাব কেমন?
সুলতান মাহমুদ: আমার স্ত্রী আমাকে সব সময় প্রতিটি দুর্ঘটনার উদ্ধারকাজের জন্য অনুপ্রেরণা জোগান। সব সময় একটা কথা বলেন, দুর্ঘটনায় গিয়ে যদি একটি প্রাণ বাঁচানো যায়, তাহলে একটি সংসার বেঁচে যাবে। তাই তিনিও জীবন রক্ষাকে গুরুত্ব দিতে বলেন। তা ছাড়া উদ্ধারকাজের সময় যেন মাথা ঠান্ডা রাখি, সে বিষয়ে পরামর্শ দেন।
উদ্ধারকাজে গিয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা উদ্বিগ্ন থাকে। বিশেষ করে বিএম কনটেইনার ডিপোর দুর্ঘটনার পর তাদের চিন্তা বেড়ে গেছে। যখন বাসায় ফিরি, ছেলেমেয়েরা আব্বু বলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে।
প্রথম আলো: ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্বাধীনতা পদক পাচ্ছে, সে বিষয়ে আপনার অনুভূতি কী?
সুলতান মাহমুদ: বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সব সময় সবার আগে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। নিজের জীবন উৎসর্গ করে জনগণের জানমাল রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। এ ছাড়া সমাজসেবা, জনসেবাসহ প্রতিটি কাজে অবদান রাখছে। এ বাহিনীর সদস্য হতে পেরে গর্ব বোধ করছি।