অধ্যাপক সিতারা পারভীন, ১৯৮৮ সালে ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে
অধ্যাপক সিতারা পারভীন, ১৯৮৮ সালে ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে

সিতারা আপা বলতেন, ‘অ্যাভয়েড নেগেটিভ থিঙ্কিং’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. সিতারা পারভীন ২০০৫ সালের ২৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আজ তাঁর ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।

মনে হয়, এই তো সেদিন, ২০০৫ সালের এক বর্ষণসিক্ত সকালে খবর পেলাম, সিতারা পারভীন নেই! ওই দিন রাতে তাঁর স্বজন ও পরিচিতজনেরা সবাই যখন ঘুমিয়ে, তখন ১২ ঘণ্টা দূরের এক শহর থেকে তিনি উড়াল দিলেন অসীমে। নিয়ন্ত্রণহীন যন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রের মতোই বিকল হলো তাঁর দেহ। ‘প্রিয়তম পাতাটি ঝরে গেল!’ ২০০৫ সালের ২৩ জুন ড. সিতারা পারভীন; আমাদের প্রিয় সিতারা আপা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো থেকে ক্যানসাসে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তিনি আইডব্লিউপিআরের আমন্ত্রণে একটি কনফারেন্সে অংশ নিতে২০০৫ সালের ১৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। ২৩ জুন ছিল তাঁর জীবনের শেষ পথচলা। তারপর, বাকি সব ইতিহাস।

২.

ড. সিতারা পারভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি সব সময় চলতেন অতি সাধারণ মানুষের মতো। পরতেন সাধারণ সুতির শাড়ি। ব্যক্তিজীবনের সাধারণত্বই তাঁকে দিয়েছে অমরত্ব। করেছে চিরস্মরণীয়।

আজকের সমাজে ক্ষমতার মোহ আর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ যখন সমাজকে কলুষিত করে চলেছে, তখন সিতারা পারভীন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে দেখা দেন। বিত্তবৈভব আর ক্ষমতার মধ্যে থেকেও তিনি কীভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন, তা কল্পনা করাও কঠিন। ১৯৯৬ সালে তাঁর বাবা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দেশের রাষ্ট্রপতি হলে তিনি হন ‘রাজকন্যা’। কিন্তু তিনি কোথাও তাঁর এই ব্যক্তিগত পরিচয় দিতেন না। কোনো বাড়তি সুবিধা নেওয়ার কথা তো কল্পনাতীত। অনেক সময় তিনি রাষ্ট্রপতির বিশেষ নিরাপত্তাবেষ্টনীর অনেক দূরে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, তবু নিজের পরিচয় দেননি। এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়।

১৯৫৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর সিতারা পারভীনের জন্ম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (সম্মান) ও এমএ এবং আবার সাংবাদিকতায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পিএইচডি করেন ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৮২ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমৃত্যু। ড. সিতারা পারভীনের গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, নারী ও আদিবাসী। আদিবাসীবিষয়ক গবেষণায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন মাতৃতান্ত্রিক মান্দি (গারো) সম্প্রদায়কে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মান্দি-অধ্যুষিত মধুপুর, দুর্গাপুর, বিরিশিরিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি দীর্ঘদিন গবেষণার কাজ করেছেন।

ড. সিতারা পারভীন শুধু বড় মাপের শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বড় মনের মানুষও। নিয়মনিষ্ঠ এই মানুষ তাঁর অল্প পরিচিত কোনো শিক্ষার্থীর ছোট্ট প্রয়োজনেও এগিয়ে আসতেন। সিতারা পারভীন কখনোই ব্যক্তিত্বের কোনো কঠিন দেয়াল তৈরি করতেন না। যে কেউই তাঁর কাছে যেকোনো সমস্যা নিয়ে হাজির হতে পারতেন। আপা তাঁদের কথা শুনতেন অকাতরে। শিক্ষার্থীরা তাঁদের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে সিতারা আপার সঙ্গে আলাপ করতেন। সিতারা পারভীন শিক্ষার্থীদের কাছে যেমন প্রিয় ছিলেন, তেমনই প্রিয় ছিলেন সহকর্মীদের কাছেও। তাঁর সহকর্মী সাংবাদিকতা বিভাগের সাধারণ কর্মচারীরাও তাঁকে আশ্রয়ের ক্ষেত্র মনে করতেন। যেকোনো প্রয়োজনে আপাকে বললে তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন, পাশে দাঁড়াতেন।

সিতারা পারভীন প্রচলিত অর্থে নারীবাদী ছিলেন না। কিন্তু তিনি নারী-অধিকার বিষয়ে সচেতন ছিলেন। সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি ‘চেয়ারপারসন’ শব্দটির প্রয়োগ শুরু করেন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন নারী-পুরুষ সব শিক্ষকের জন্য এই শব্দের ব্যবহার স্থায়ীভাবে চালু করতে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত এই পরিবর্তন স্থায়ী করতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকাশনা বা একাডেমিক কাজে এখনো ‘চেয়ারম্যান’ শব্দটিই দেখা যায়। এই শব্দের পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শব্দটির পরিবর্তন করে তাঁর প্রতি সম্মান জানানোর উদ্যোগ নেবে কি?

৩.

বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়, বুঝি না কেন একই বেদনাবোধ, একই হাহাকার জারিত হয় সমস্ত সত্তায়। যখন ‘চারপাশে সব মুখস্থ মানুষ দেখি’, ভণ্ডামি আর শঠতায় ভরা সম্পর্ক দেখি, তখনই মনে পড়ে সিতারা আপার কথা। আয়নার পারদে নিজেকে শুধাই, আমরা, এ কালের প্রজন্ম কি তাঁর মতো জীবনের কথা বলতে পারব? তাঁর মতো সরল ও সত্য-সাহসে দাঁড়াতে পারব যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি?

ড. সিতারা পারভীন আমার শিক্ষক ছিলেন। বলা ভালো, এখনো আছেন। সিতারা আপা প্রায়ই বলতেন, ‘অ্যাভয়েড নেগেটিভ থিঙ্কিং (নেতিবাচক চিন্তা এড়িয়ে চলো)। দেখো, এতেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ সামান্য এই দর্শন একসময় আমাকে আমূল আলোড়িত করেছিল। আমি এখনো আপার এ কথা বিশ্বাস করি, মান্য করি এবং প্রয়োগ করার চেষ্টা করি।

১৯ বছর হলো সিতারা আপার বিদায়ের কাল। আমাদের প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় মানুষ সিতারা পারভীনের মৃত্যুদিনে আজ তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা, পরম মমতা আর ভালোবাসায়।

ফিরোজ চৌধুরী: সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

firoz.choudhury@gmail.com