১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই নিশ্চিত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়। অংশগ্রহণকারীদের জবানিতে সেসব বিজয়–দিনের কাহিনি।
৯ ডিসেম্বর আমরা শুভপুর অতিক্রম করে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রাভিযান শুরু করি। ওই দিনই করের হাটে রাত আটটায় কে ফোর্সের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার এবং ভারতীয় ৮৩তম পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপের সভাপতিত্বে সব ইউনিট কমান্ডারদের সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ফোর্স কমান্ডার তাঁর অপারেশন পরিকল্পনা আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন। সিদ্ধান্ত হয় যে আমি চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল ও মুজিব ব্যাটারিকে নিয়ে হিয়াকু–ফটিকছড়ি–নাজিরহাট–হাটহাজারী–চট্টগ্রাম অক্ষে অগ্রাভিযান করব।
অন্যদিকে ব্রিগেডিয়ার আনন্দ স্বরূপের সরাসরি নেতৃত্বে দশম ইস্ট বেঙ্গল ও অন্য দুটি ভারতীয় পদাতিক ব্যাটালিয়ন ভারতীয় গোলন্দাজদের সহায়তায় সীতাকুণ্ড–কুমিরা–ভাটিয়ারী–ফৌজদারহাট–হাটহাজারী–চট্টগ্রাম অক্ষে অগ্রাভিযান করবে। ঠিক হয় যে আমাদের উভয় বাহিনী হাটহাজারীতে একত্র হয়ে একযোগে চট্টগ্রামে শত্রুর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ব।
পরিকল্পনা মোতাবেক ৯ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১২টার সময় আমি আমার নির্ধারিত অক্ষে অগ্রাভিযান শুরু করি এবং ১০ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে ছয়টায় হিয়াকুতে পৌঁছাই। হিয়াকু বাজারে শত্রুর একটা প্লাটুন ডিলেইং অবস্থানে ছিল। তারা প্রথমে আমাদের কিছুটা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু মুজিব ব্যাটারি ও আমাদের মর্টার প্লাটুনের তুমুল গোলাবর্ষণের মুখে অতি দ্রুতই তারা অবস্থান তুলে নিয়ে ফটিকছড়ির দিকে পালিয়ে যায়। ফলে আমরা খুব সহজেই হিয়াকু শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হই।
হিয়াকু থেকে পরের রাস্তা ছিল খুবই অনুন্নত, জঙ্গলঘেরা এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি পথ। অত্যন্ত বিপৎসংকুল এই পথে মাঝেমধ্যেই আমাদের গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। ফলে আমাদের অগ্রাভিযানের গতি ধীর হয়ে পড়ছিল।
অগ্রসর হওয়ার পথে বিবিরহাট ও হিয়াকুর মাঝামাঝি একটি চৌরাস্তায় আমি দেখি একজন সশস্ত্র পাঞ্জাবি সৈনিক আমার গাড়িকে আসার জন্য ইশারা করছে। তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হলো, সৈন্যটি আমাদের গাড়িটিকে তাদের পক্ষের বলে মনে করেছে। সম্ভবত তার নিজের দলের সৈন্যরা তাড়াহুড়া করে পশ্চাদপসরণ করার সময় তাকে ডাকতে ভুলে গিয়েছিল।
আমি নিজে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত না নিলে শত্রুসৈন্যটি বুঝতে পেরে গুলি ছুড়তে শুরু করলে আমাদের গাড়ির সবাই মারা পড়ব, এমনই অবস্থা। আমি চকিতেই সৈন্যটির ওপর গাড়ি চালিয়ে দিলাম ও তাকে গুরুতর আহত করলাম। যদিও আমি সঙ্গে সঙ্গেই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মৃত্যুবরণ করল।
বিকেল চারটা নাগাদ আমরা নারায়ণহাটে শত্রুর একটি ডিলেইং পজিশনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হই। প্রায় আধঘণ্টা ধরে গোলাগুলির পর শত্রুরা পিছু হটতে থাকে এবং একসময় ফটিকছড়ির দিকে পালিয়ে যায়। আমরা নারায়ণহাট মুক্ত করার পর সেখানেই ব্যাটালিয়নকে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়ে রাত কাটাই।
সূত্র: স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ ও আমার সামরিক জীবন, এইচ এম আবদুল গাফফার, বীর উত্তম, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৬
লে. কর্নেল এইচ এম আবদুল গাফফার, বীর উত্তম: বীর মুক্তিযোদ্ধা; অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।