টিকে থাকার জন্যই গণমাধ্যমগুলোকে জেন্ডার সমতা মাথায় রাখতে হবে: গীতিয়ারা নাসরীন

গণমাধ্যমে জেন্ডারভিত্তিক সংবাদ উপস্থাপন পর্যবেক্ষণের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকেরা। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সার্কিট হাউস রোডে পিআইবির সেমিনারকক্ষে
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরীন বলেছেন, গণমাধ্যমে নারী অডিয়েন্সের (পাঠক, দর্শক, শ্রোতা) সংখ্যা বেড়েছে। নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ফলে ‘বাইং পাওয়ার’ বেড়েছে। গণমাধ্যমে নারীরা নিজেদের খবরগুলো দেখতে চান। ‘বিজনেস মডেল’ অনুসরণ করে টিকে থাকার জন্যই গণমাধ্যমগুলোকে নারী-পুরুষসহ জেন্ডার সমতার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

আজ বৃহস্পতিবার ‘গণমাধ্যমে জেন্ডারভিত্তিক সংবাদ উপস্থাপন পর্যবেক্ষণের ফলাফল’–বিষয়ক আলোচনায় অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরীন এ কথা বলেছেন। প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) এবং সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর মিডিয়া ইন ডেভেলপমেন্ট (সাকমিড) যৌথভাবে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। রাজধানীর সার্কিট হাউস রোডে পিআইবির সেমিনারকক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় সাকমিডের প্রোগ্রাম অফিসার সাইদুল ইসলাম ‘গণমাধ্যমে জেন্ডারভিত্তিক সংবাদ উপস্থাপন পর্যবেক্ষণের ফলাফল’ উপস্থাপন করেন। ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড এবং বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন বাংলাদেশের প্রটেক্টিং ইনডিপেনডেন্ট মিডিয়া ফর ইফেক্টিভ ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় সাকমিড দুটি অনলাইন, দুটি বেসরকারি টেলিভিশন, স্থানীয় পর্যায়ের দুটি সংবাদপত্রসহ মোট ছয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদ মনিটর করছে। জুলাই থেকে অক্টোবর মাসের এই ছয় গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ, নারীকে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে—এ ধরনের বিভিন্ন তথ্য জানানোর জন্যই আজকের সভার আয়োজন করা হয়।

তবে সভায় গণমাধ্যমে জেন্ডারভিত্তিক সংবাদ উপস্থাপন পর্যবেক্ষণের ফলাফল উপস্থাপনের পর অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরীন তাঁর বক্তব্যে বলেন, সাকমিড যে ছয় গণমাধ্যমকে বেছে নিয়েছে এবং তার যে ফলাফল প্রকাশ করছে, তা সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। একটি–দুটি গণমাধ্যম মনিটর করে পাওয়া ফলাফল সঠিক চিত্র তুলে ধরে না। গ্লোবাল মিডিয়া মনিটরিং প্রজেক্টে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, নমুনা হিসেবে বেছে নিতে হলে যে গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা বেশি বা বেশি প্রভাব বিস্তার করছে, তেমন গণমাধ্যম এবং যার প্রভাব কম, তা–ও মনিটরের আওতায় রাখতে হবে। এখানে তা করা হয়নি।

অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরীন বলেন, ৭৫ বছর আগে ‘বেগম’ পত্রিকা বের হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, সাংবাদিকতায় নারীরা এগিয়ে আসছে। এটি পিঠ চাপড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বলেন, সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে ভালো রিপোর্টিং হলে জেন্ডার বিষয়ে যত বৈষম্য, তা অনেক কমে যেত। কেননা, ভালো রিপোর্টিং মানেই সব দৃষ্টিকোণ বিবেচনা করে রিপোর্টটি করা হয়েছে। সাকমিড গণমাধ্যমে জেন্ডারভিত্তিক সংবাদ উপস্থাপন পর্যবেক্ষণ করছে, এটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদেরই করার কথা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সভায় প্যানেল আলোচকদের গণমাধ্যমে জেন্ডারভিত্তিক সংবাদ উপস্থাপন পর্যবেক্ষণের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করার কথা থাকলেও অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরীন পর্যবেক্ষণের ফলাফল গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করার পর আলোচকেরা এ ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেননি। আলোচকেরা তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে গণমাধ্যমে নারী-পুরুষের সমতা তৈরিতে যে সমস্যাগুলো আছে, তা তুলে ধরেন।

আলোচনা সভায় সাকমিডের উপপরিচালক সৈয়দ কামরুল হাসান ও পিআইবির প্রশিক্ষণ বিভাগের কনিষ্ঠ প্রশিক্ষক মো. শাহ আলম সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।

আলোচনায় পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ বলেন, সংবাদপত্রের নারী পাতাগুলো সবচেয়ে অবহেলিত পাতা। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে দক্ষ ব্যক্তিদের কাজে লাগানো হয় না। সাংবাদিকদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদায়ঘণ্টাও বাজতে থাকে। মালিকপক্ষ মনে করেন, এই একজনের বেতন দিয়ে তিনজন কর্মী রাখা সম্ভব। মালিকপক্ষের এ মনমানসিকতার পরিবর্তন না হলে গণমাধ্যমের গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।

আলোচনায় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের জ্যেষ্ঠ নিউজ এডিটর মীর মাসরুর জামান বলেন, গণমাধ্যমে যে নারীরা কাজ করেন, সমাজ ও পরিবারে তাঁদেরও অনেক সময় নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছেন নারীরা। কর্মসংস্থানও হচ্ছে। তবে কর্মক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের দেখা যাচ্ছে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে নারীরা এ ধরনের অবস্থানে আছেন, তাঁদের জেন্ডার লেন্স কতটুকু কাজ করে, তা–ও দেখতে হবে।

নিজের অভিজ্ঞতায় মীর মাসরুর জামান বলেন, ‘নারী কর্মীর মাতৃত্বকালীন ছুটির সময় আমিও ভ্রু কুঁচকে তাকাই। এই নারী ছুটিতে থাকবেন, সেই সময়ে তিনি যে কাজ করতেন, সেখানে মালিকপক্ষ নতুন কর্মী দিচ্ছেন না, কিন্তু আমাকে তো চ্যানেল চালাতেই হবে।’

আলোচকেরা বলেন, সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এখনো নারী সাংবাদিকের সংখ্যা অনেক কম। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার চিত্রও হতাশাজনক। আলোচকেরা গণমাধ্যমের জন্য জেন্ডার নীতিমালা থাকার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। নারী সাংবাদিকদের কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন তাঁরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মিনহাজ উদ্দিন, বাংলাভিশন টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক রুহুল আমিন রুশদ, দৈনিক কালবেলার বিশেষ প্রতিনিধি আঙ্গুর নাহার মন্টি, দৈনিক প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মানসুরা হোসাইন, বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন বাংলাদেশের প্রজেক্ট অফিসার শারিন আহসান আলোচনায় অংশ নেন।