জনশুমারি ও গৃহগণনা

পরিবার আরও ছোট হয়েছে, বেড়েছে ঢাকার জনসংখ্যা

দেশে একান্নবর্তী পরিবার আরও কমে গেছে। পরিবারের সদস্যের আকার ছোট হয়ে চারের নিচে নেমে গেছে। এক দশক আগে ছিল প্রায় সাড়ে চারজন। সেটি কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ জন।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পরিসংখ্যান ভবন মিলনায়তনে জনশুমারির প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বিবিএস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবার ছোট হওয়ার পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমে গেছে। দেশে এখন বার্ষিক গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ। এক দশক আগে ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

পরিবার ছোট হওয়ার পেছনে দুটি কারণ বলছেন জনসংখ্যাবিশারদেরা। যেমন চাকরি সূত্রে কিংবা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কারণে একান্নবর্তী পরিবার ভাঙছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ায় সন্তান নেওয়ার হার কমেছে।

দেশজুড়ে ষষ্ঠ জনশুমারি অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের ১৫ থেকে ২১ জুন। একই বছরের ২৭ জুলাই শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তখন জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৫১ লাখ। গতকাল ৫১৯ পৃষ্ঠার জাতীয় প্রতিবেদন (ভলিউম ১) প্রকাশ করা হয়। তাতে দেখা যায়, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। এর মধ্যে নারী ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার (৫০.৪৬ শতাংশ)। পুরুষ ৮ কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার (৪৯.৫৪ শতাংশ) অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে নারী প্রায় ১৬ লাখ বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম মনে করেন, নারী আয়ুষ্কাল বেড়েছে। পুরুষেরা তুলনামূলকভাবে দেশের বাইরে বেশি যাচ্ছেন। সে কারণে পুরুষের তুলনায় নারী বেশি। তবে শুমারির সময় বাসাবাড়িতে পুরুষ না থাকায় শুমারিতে সঠিক তথ্য উঠে আসেনি বলেও মনে করেন তিনি।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, সিটি করপোরেশনে জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ১২ সিটি করপোরেশনে ২ কোটি ১১ লাখ ২২ হাজার মানুষ বসবাস করছে। ২০১১ সালের পঞ্চম জনশুমারিতে যা ছিল ১ কোটি ১৪ লাখ। প্রায় দ্বিগুণ জনসংখ্যা বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে, প্রায় ৬০ লাখ। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৪৩ লাখ।

মঈনুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দেশে নগরায়ণ বাড়ছে। মানুষ কর্মসংস্থানের আশায় গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এর আরেকটি কারণ। সে জন্য সিটি করপোরেশনে বসবাসের হার বাড়ছে। তবে সংজ্ঞার কারণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যার সঠিক চিত্র উঠে আসেনি বলে মনে করেন মঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে জনসংখ্যা আরও বেশি। শুমারিতে সঠিক তথ্য উঠে আসেনি।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২৭ হাজার ৮৪২ জন বিদেশি নাগরিক বসবাস করছেন। এর মধ্যে পুরুষ ২১ হাজার ২০৮ ও নারী ৬ হাজার ৬৩৪ জন। বিবিএসের এ তথ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিতর্ক চলছে। বেসরকারি একাধিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে দেশে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কার নাগরিকের সংখ্যা বেশি। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত জুনে সংসদে জানান, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১১৫টি দেশের ২০ হাজার ৯৮৮ জন নাগরিক ওয়ার্ক পারমিট (অনুমতি) নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছেন।

মূল প্রবন্ধে প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন বলেন, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩৪ শতাংশ মানুষ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থান কোথাও নেই। যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ওপর জোর দিতে বলেন তিনি।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাবধারী আছে ২৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবধারী, যাদের বয়স ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে, এ হার ৩৯ দশমিক ১১ শতাংশ।

অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ৫০ লাখ ৫৩ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক বসবাস করছেন বলে জনশুমারি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বলা হয়, সবচেয়ে বেশি মানুষ গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে। সবচেয়ে কম মানুষ গেছেন রংপুর বিভাগের। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ১ কোটি ৫৫ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি থাকেন বলে গত সেপ্টেম্বরে সংসদে জানিয়েছেন, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ।

দুই সংস্থার দুই ধরনের তথ্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব দীপংকর রায় সাংবাদিকদের বলেন, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিবিএসের এ তথ্য তুলনা করা ঠিক হবে না। বিবিএসের এ তথ্য শুধু শুমারিকালীন যাঁরা বিদেশে অবস্থান করছিলেন, তাঁদের তথ্য। যখন শুমারি হয়েছিল, তখন পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ছয় মাস আগে কেউ বিদেশ গেছেন কি না। এখানে শুধু তাঁদের তথ্য নেওয়া হয়েছে। আর বিএমইটির তথ্য হচ্ছে ১৯৭৬ সাল থেকে যাঁরা বিদেশে গেছেন, তাঁদের তথ্য। তাঁদের সংখ্যা বেশি হবেই।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। আরও বক্তব্য দেন পরিকল্পনা কমিশনের সচিব নাসিমা বেগম, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) কাউসার আহাম্মদ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব শাহনাজ আরেফিন। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব দীপংকর রায়ের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান।

অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘প্রবাসীর সংখ্যা নিয়ে আমার কোনো জবাব নেই। গত বছরের জুন মাসে যখন শুমারি হয়, তার ছয় মাস আগে যাঁরা প্রবাসে গেছেন, শুধু তাঁদের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এর আগে যাঁরা বিদেশে গেছেন, তাঁদের তথ্য আসেনি। প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বিতর্কমুক্ত থাকুক।’