ধরেই বেঁধে ফেলা হতো হাত ও চোখ। মুখমণ্ডল ঢেকে দিতে পরানো হতো টুপি। নিয়ে যাওয়া হতো গোপন বন্দিশালায়। জানালাবিহীন ছোট্ট কক্ষটিতে সার্বক্ষণিক উচ্চ আলোর বাতি জ্বলে। রাত–দিন বোঝার উপায় নেই। কখনো কখনো বাতি বন্ধ করে দিত, তখন নেমে আসত ঘুটঘুটে অন্ধকার। এগজস্ট ফ্যানের বিকট শব্দের কারণে শোনা যেত না বাইরের কোনো শব্দ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে ও পরে গোপন বন্দিশালা থেকে ছাড়া পাওয়া ব্যক্তিদের কয়েকজন বন্দিশালার এমন চিত্র তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেন, ওই অজ্ঞাত বন্দিশালায় বেঁচে থাকাটাও ছিল দুঃসহ যন্ত্রণার। সারাক্ষণ মৃত্যুর প্রহর গুনতে হতো, এই বুঝি বের করে নিয়ে গেল।
একাধিক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, তুলে নেওয়ার পরপর ব্যাপক শারীরিক নির্যাতন করা হতো। কাউকে কাউকে মাঝেমধ্যে নিয়ে যেত নির্যাতনকক্ষে (টর্চার সেল)। চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পরা অবস্থায় শৌচাগারে আনা-নেওয়ার পথে নির্যাতনের শিকার অন্যদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যেত।
২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় দেখা গেছে, তুলে নেওয়া ব্যক্তিদের মুখমণ্ডলে পলিথিন পেঁচিয়ে রেখে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এরপর পেট কেটে মৃতদেহের সঙ্গে সিমেন্ট বা ভারী বস্তু বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। আবার কাউকে কাউকে লম্বা সময় পরে কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
গুমসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করে, এমন সূত্রগুলো বলছে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হতো, তাঁদের এমন গোপন বন্দিশালায় রাখা হতো। আবার তুলে নেওয়ার পরপর বা অল্প দিনের মধ্যে মেরে ফেলা হয়েছে। ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় দেখা গেছে, তুলে নেওয়া ব্যক্তিদের মুখমণ্ডলে পলিথিন পেঁচিয়ে রেখে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এরপর পেট কেটে মৃতদেহের সঙ্গে সিমেন্ট বা ভারী বস্তু বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। আবার কাউকে কাউকে লম্বা সময় পরে কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। কারও কারও লাশ উদ্ধার হয়। কারও লাশও পাওয়া যায়নি।
শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সাল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী বা লক্ষ্যবস্তু করা ব্যক্তিদের গুম করার প্রবণতা শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এটা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। শুরু থেকেই এ ঘটনায় সরকারি বাহিনী জড়িত বলে অভিযোগ উঠলেও তৎকালীন সরকার সেটা আমলে নেয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘পাওনাদারের ভয়ে পালিয়ে আছে’ বলে উপহাসমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়া, গোপন বন্দিশালা বন্ধ করা এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জোরালোভাবে উঠেছে।
এমন একটা প্রেক্ষাপটের মধ্যে আজ ৩০ আগস্ট পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস।
গুমসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করে, এমন সূত্রগুলো বলছে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হতো, তাঁদের এমন গোপন বন্দিশালায় রাখা হতো। আবার তুলে নেওয়ার পরপর বা অল্প দিনের মধ্যে মেরে ফেলা হয়েছে।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০০৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৬২৯ জন গুমের শিকার হয়েছেন। পরে বিভিন্ন সময় লাশ উদ্ধার হয় ৭৮ জনের, অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয় ৫৯ জনকে। পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৭৩ জনকে। বাকি ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাক ১৮ আগস্ট এখনো নিখোঁজ ১৫৮ জনের একটি তালিকা দিয়ে আসে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালকের কাছে। যাঁরা ২০০৯ সালের পর থেকে গুম হন।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে স্বজনেরা দীর্ঘদিন ধরে নানা কর্মসূচি পালন করে এলেও গোপন বন্দিশালার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে দুই বছর আগে। ২০২২ সালের আগস্টে ‘আয়নাঘর: ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালা’ শিরোনামে সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজের এক প্রতিবেদনের পর। বন্দিশালা থেকে ছাড়া পাওয়া সাবেক একজন সেনা কর্মকর্তাসহ কয়েকজনের বর্ণনায় প্রকাশ পায় ‘আয়নাঘরের’ রোমহর্ষ কাহিনি।
আয়নাঘর নামের ব্যাখ্যায় দুই দফা গুমের শিকার সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান বলেন, প্রহরীরা মাঝেমধ্যে অবজ্ঞা করে বলত, আয়নাঘরের মধ্যে আছেন। আয়নাঘর একটি রূপক নাম। যেখানে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না।
২০২২ সালের আগস্টে ‘আয়নাঘর: ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালা’ শিরোনামে সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজের এক প্রতিবেদনের পর। বন্দিশালা থেকে ছাড়া পাওয়া সাবেক একজন সেনা কর্মকর্তাসহ কয়েকজনের বর্ণনায় প্রকাশ পায় ‘আয়নাঘরের’ রোমহর্ষ কাহিনি।
মানুষকে গুম ও গোপন বন্দিশালার কথা শেখ হাসিনা সরকার স্বীকার করেনি। এ নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর আহ্বানকেও উপেক্ষা করেছিল। তবে এখন অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পরদিন ৬ আগস্ট গোপন বন্দিশালা থেকে ছাড়া পান দীর্ঘদিন গুম থাকা তিনজন। তাঁরা হলেন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী, আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান) ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠন পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা। প্রথম দুজন প্রায় আট বছর এবং শেষের জন পাঁচ বছরের বেশি সময় গোপন বন্দিশালায় ছিলেন।
মাইকেল চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলো-বাতাসহীন চার দেয়ালের মধ্যে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না। এতটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম যে তাদের বলেছি এভাবে বাঁচিয়ে না রেখে যেন আমাকে মেরে ফেলা হয়। নির্যাতনের সেই ভয়াবহতার কারণে আমি এখনো ঘুমোতে পারি না। কোনো শব্দ শুনলেই আঁতকে উঠি।’
গত ১৫ বছরে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন, তাদের নিয়ে সমালোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভয় ছিল গুম ও গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখা। এসব কারণে সেখানে যাঁদের নেওয়া হতো, তাঁরা বেঁচে থেকেও ছিলেন মৃতপ্রায়। গোপন বন্দিশালা থেকে ফেরা ব্যক্তিদের বেশির ভাগই এখনো মানসিকভাবে স্বাভাবিক হতে পারেননি।
আলো-বাতাসহীন চার দেয়ালের মধ্যে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না। এতটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম যে তাদের বলেছি এভাবে বাঁচিয়ে না রেখে যেন আমাকে মেরে ফেলা হয়। নির্যাতনের সেই ভয়াবহতার কারণে আমি এখনো ঘুমোতে পারি না। কোনো শব্দ শুনলেই আঁতকে উঠি।মাইকেল চাকমা
গোপন বন্দিশালা থেকে এর আগে মুক্তি পেয়েছেন, এমন আরও কয়েকজনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, তাঁরা বন্দিশালায় অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন। বন্দীদের থাকার কক্ষগুলো ঘিরে বড় আকারের এগজস্ট ফ্যান চালিয়ে রাখা হতো। এই ফ্যানগুলো এত জোরে শব্দ করত যে বাইরের কোনো কিছু শোনা যেত না। কেউ ভালোভাবে ঘুমাতেও পারতেন না। আবার এগজস্ট ফ্যান বন্ধ হলে প্রচণ্ড চিৎকার ও মানুষের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন কেউ কেউ। কখনো কখনো ইচ্ছা করেই অন্য বন্দীদের নির্যাতনের চিৎকারের শব্দ শোনানো হতো বলেও মনে করছেন তাঁরা।
গোপন বন্দিশালা থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা বলছেন, তাঁদের যে কক্ষগুলোতে রাখা হতো, তা ছিল খুবই ছোট। কক্ষগুলোতে ৩ বাই ৭ ফুটের একটি খাট বসানোর পর ৩-৪ ফুটের মতো ফাঁকা জায়গা ছিল। ভেতরে কোনো শৌচাগার ছিল না। অধিকাংশ কক্ষই ছিল স্যাঁতসেঁতে ও নোংরা। কক্ষগুলোতে ছারপোকা ও মশার তীব্র উপদ্রব ছিল। ভবনের পার্শ্ববর্তী কক্ষগুলোতে ভেন্টিলেটর দিয়ে সামান্য দিনের আলো দেখা যেত। তবে ভেতরের কক্ষগুলো ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেখানে বিদ্যুৎ চলে গেলে নিজের শরীরও দেখা যেত না।
বন্দীদের পরিধানের জন্য দেওয়া হতো পুরোনো কাপড়। খাটে বিছানো থাকত পুরোনো নোংরা চাদর। চার-পাঁচটি কক্ষের জন্য একটি শৌচাগার ছিল। একজন বন্দী দিনে চার-পাঁচবার শৌচাগারের যাওয়ার সুযোগ পেতেন। তখনো চোখ বেঁধে, হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কক্ষ থেকে বের করা হতো। শৌচাগারের দরজা ছিদ্র দিয়েও দেখা হতো বন্দীর গতিবিধি। কোনো স্যান্ডেল দেওয়া হতো না, ফলে খালি পায়ে হাঁটতে হতো।
ভবনের পার্শ্ববর্তী কক্ষগুলোতে ভেন্টিলেটর দিয়ে সামান্য দিনের আলো দেখা যেত। তবে ভেতরের কক্ষগুলো ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেখানে বিদ্যুৎ চলে গেলে নিজের শরীরও দেখা যেত না।
দুই দফায় দীর্ঘ সময় গুম ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান। নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে থাকার কক্ষে এসে শক্তভাবে চোখ বাঁধা হতো। তারপর টর্চার সেলে নিয়ে যেত। সেখানে হাত-পা চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা হতো। সেখানে কাউকে ঝোলানো হতো, কারও নখ উপড়ে ফেলত; যাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নির্যাতন করা হতো। কেউ যখন কান্নাকাটি করতে করতে কক্ষে আসত, তখন বুঝতাম যে তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের মাসে একবার এভাবে নির্যাতন করা হতো।
গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্ত হওয়া ব্যক্তিরা জানান, আটক থাকা অবস্থায় তাঁদের বেশির ভাগই জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বছরের পর বছর বন্দিশালায় থাকতে থাকতে তাঁদের কেউ কেউ ভেবেছিলেন, হয়তো সেখানেই তাঁদের মৃত্যু হবে। যদিও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে গোপন বন্দিশালা থেকে কেউ কেউ বেরও হয়েছেন। তবে তাঁরা যে মাত্রার নির্যাতন দেখে এসেছেন, সেই ভয়ে পরে কেউ এ নিয়ে মুখ খুলতে সাহস করেননি।
পরে আমি যখন এ বিষয়ে সোচ্চার হই, তখন বড় ত্রিপল দিয়ে দুটি ভবন ঢেকে দেওয়া হয়। যাতে স্যাটেলাইট থেকেও ভবনের ছবি পাওয়া না যায়।হাসিনুর রহমান
আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালা কতটি আছে, সেটার নিশ্চিত কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে যে একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতো, সেটা মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের বর্ণনায় অনেকটা স্পষ্ট। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁদের যেসব ওষুধ, খাবার, বই ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দেওয়া হতো, তাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের লোগো বা লেখা দেখতে পেয়েছেন। তা ছাড়া তাঁদের পাহারা দেওয়ার জন্য নিয়োজিত ব্যক্তি, চিকিৎসক, নরসুন্দর ও খাবার সরবরাহকারীদের আচরণ ও কথাতেও এটা প্রকাশ পেয়েছে যে তাঁরা সশস্ত্র বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত ছিলেন।
দুই দফায় ‘আয়নাঘরে’ বন্দী থাকা সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, পাকিস্তান আমলে সেনানিবাসের ভেতরে কচুক্ষেতের একটি ভবনে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলের (জেআইসি) কক্ষ ছিল। পরিত্যক্ত সেই কক্ষগুলোতে এক-এগারোর সময় অনেককে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ওই কক্ষগুলোকে বন্দিশালা ও টর্চার সেল হিসেবে পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগানো শুরু হয়। এর বাইরে স্বল্প সময় রাখার জন্য র্যাবের নিজস্ব গোপন বন্দিশালা ছিল। সেনাবাহিনীর ইন্টারোগেশন সেলের অপব্যবহার করেও বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে।
আয়নাঘর বা আলোচিত গোপন বন্দিশালার অবস্থান সম্পর্কে হাসিনুর রহমান বলেন, আয়নাঘরের অবস্থান কচুক্ষেতের ডিজিএফআইয়ের অফিসের ৩০-৪০ গজ পেছনে, অর্থাৎ দক্ষিণ পাশে। সেখানে পাকিস্তান আমলের ১৮ ফুট উচ্চতার একটি একতলা ও ২০ ফুট উচ্চতার দ্বিতলবিশিষ্ট একটি ভবন রয়েছে। পাশেই ছিল একটি মসজিদ। ২০০৯ সালে নতুন ভবনটি তৈরি করা হয়। নতুন ভবনে ১০টি এবং পুরোনো ভবনে ১৭টি কক্ষ রয়েছে।
জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল, আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালা যে নামেই বলি না কেন, এটি একটি জায়গায় নয়, একাধিক জায়গায় এমনটা ছিল বলে আমরা জেনেছি। কোথায় কোথায় এই ব্যবস্থা ছিল এবং এখনো কেউ সেখানে আছে কি না, সেটা চিহ্নিত করা দরকার।মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান
হাসিনুর রহমান বলেন, ‘পরে আমি যখন এ বিষয়ে সোচ্চার হই, তখন বড় ত্রিপল দিয়ে দুটি ভবন ঢেকে দেওয়া হয়। যাতে স্যাটেলাইট থেকেও ভবনের ছবি পাওয়া না যায়।’
ডিজিএফআই কার্যালয়ের কাছাকাছি সেনানিবাস এলাকায় আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালা পরিচালিত হয়েছে বলে যে অভিযোগ বা আলোচনা সামনে এসেছে; এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালকের সঙ্গে গতকাল যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেছেন, সেনানিবাসের অভ্যন্তরে কোনো স্থাপনার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে। এ ছাড়া ডিজিএফআই আইএসপিআরের আওতাধীন বিষয় নয় বলেও জানান তিনি।
এর বাইরে কেউ কেউ বলছেন, র্যাব ও পুলিশের কোনো কোনো শাখারও নির্যাতনের এমন সেল ছিল। বিশেষ করে উত্তরায় র্যাব-১-এর কার্যালয়ের কাছে রেললাইনের পাশে এমন গোপন বন্দিশালা প্রতিষ্ঠা করেছিল, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেককে প্রথমে সেখানে নিয়ে রাখা হয়েছে। তখন মুক্তি পাওয়া দু-একজনের বর্ণনায় এমন একটা ধারণা পাওয়া যায়।
তবে গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্ত সাবেক সেনাসদস্য মো. মুকুল হোসেনের ভাষ্যে র্যাব-১ এর কার্যালয়ের বন্দিশালার একটা বর্ণনা পাওয়া যায়।
সাবেক করপোরাল মুকুল ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কলাবাগান এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। পরে ওই বছরের ৮ মে রাতে তাঁকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় র্যাব।
মুকুলকে তুলে নেওয়া, নির্যাতন ও দীর্ঘদিন যে কক্ষে আটকে রাখা হয়, সেটা অন্যদের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার আগে শেষ দিকে রাখা হয় র্যাব-১-এর ওই বন্দিশালায় রাখা হয়। সেখান থেকে তিনি রেলগাড়ি চলার শব্দ শুনতেন। পরে সেখান থেকে র্যাব-১ তাঁকে বিমানবন্দর থানায় হস্তান্তর করে এবং মাদক মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়।
র্যাবের তত্ত্বাবধানে এমন বন্দিশালা থাকা বা গুম করা ব্যক্তিদের সেখানে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে বাহিনীটির বর্তমান আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, যখনকার অভিযোগ, সেই সময়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়গুলো নিয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে এখন র্যাবে কোনো গোপন বন্দিশালা নেই। আসামি রাখার জন্য শুধু হাজতখানা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘গুমের ঘটনায় গঠিত কমিশন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ–সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত করতে চাইলে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব।’
গোপন বন্দিশালা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে গোপন বন্দিশালায় আর কেউ নেই। তা ছাড়া বর্তমান সরকার এ ধরনের বন্দিশালা রাখার পক্ষে নয়।
তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরও শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ কারও সঙ্গে এমন আচরণ করার চিন্তাও না করে।
২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবকে গুম-নির্যাতনের কাজে লাগিয়ে তাদের কলঙ্কিত করা হয়েছে। আমরা অপরাধীদের চিহ্নিত করতে চাই এবং তাদের শাস্তি দিতে চাই।’ তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।
এরই মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এর আগে ২৭ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করেছে সরকার।
এই কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্যের হাতে জোর করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য এই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।
গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল, আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালা যে নামেই বলি না কেন, এটি একটি জায়গায় নয়, একাধিক জায়গায় এমনটা ছিল বলে আমরা জেনেছি। কোথায় কোথায় এই ব্যবস্থা ছিল এবং এখনো কেউ সেখানে আছে কি না, সেটা চিহ্নিত করা দরকার।’ এ ছাড়া গুমের জন্য কারা নির্দেশ দিয়েছেন, কোন পর্যায়ে গুমের সিদ্ধান্তগুলো হতো, কোনো ব্যক্তিবিশেষ নাকি কোনো সংস্থা বা বাহিনী সিদ্ধান্ত নিত, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কী ছিল, পুরো বিষয়গুলোর নিয়ে বিশদ তদন্ত করা দরকার, যাতে এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা যায়।