১৮ ঘাটের দখল নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বিবাদ রয়েছে
১৮ ঘাটের দখল নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বিবাদ রয়েছে

১৮ ঘাটের দখল নিয়ে প্রশাসনের ঘাটে ঘাটে বিবাদ

দেশে ১৮ ঘাটের দখল নিয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের বিবাদ বাড়ছে। ঘাট-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, ঘাট ইজারা দিয়ে বছরে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় হয়। তাই কেউই ছাড়তে চায় না ঘাটের দখল।

বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে চলা বিবাদ কোথাও সিটি করপোরেশন, কোথাও উপজেলা প্রশাসন আবার কোথাও উপজেলা পরিষদের। কোথাও আবার বিভাগীয় প্রশাসন এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগও এই বিবাদে জড়িয়েছে। দফায় দফায় বৈঠক হলেও বছরের পর বছর ধরে সুরাহা হয়নি এমন বিবাদের। মন্ত্রণালয় পর্যায় থেকে উদ্যোগ নিয়েও এ সমস্যার সুরাহা করা যায়নি।

আইন অনুযায়ী, বিআইডব্লিউটিএর অন্যতম দায়িত্ব হলো ফেরিঘাট, লঞ্চ ও খেয়াঘাট উন্নয়ন ও পরিচালনা। সারা দেশে এ ধরনের ৪৬৮টি ঘাট রয়েছে।

তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, খোলামোড়া-কামরাঙ্গীরচর খেয়াঘাট, ঝাউচর-কামরাঙ্গীরচর খেয়াঘাট, শ্যামলাসি-কলাতিয়াপাড়া ফেরিঘাট এবং বসিলা-ওয়াশপুর ফেরিঘাট—চারটি ঘাট ঢাকা নদীবন্দরের আওতায়। ঘাটগুলো নিয়ে ঢাকা জেলা পরিষদের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর বিবাদ দীর্ঘদিনের।

ঘাটের নিয়ন্ত্রণ চায় বিআইডব্লিউটিএ

সারা দেশে কতটি ঘাট নিয়ে সরকারের এক দপ্তরের সঙ্গে আরেক দপ্তরের বিরোধ চলছে, তার একটি তালিকা তৈরি করেছে বিআইডব্লিউটিএ। তাতে দেখা গেছে, ১৮টি ঘাট নিয়ে এ ধরনের দ্বন্দ্ব চলছে। এসব ঘাট এখন পরিচালনা করছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। এগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় বিআইডব্লিউটিএ।

তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, খোলামোড়া-কামরাঙ্গীরচর খেয়াঘাট, ঝাউচর-কামরাঙ্গীরচর খেয়াঘাট, শ্যামলাসি-কলাতিয়াপাড়া ফেরিঘাট এবং বসিলা-ওয়াশপুর ফেরিঘাট—চারটি ঘাট ঢাকা নদীবন্দরের আওতায়। ঘাটগুলো নিয়ে ঢাকা জেলা পরিষদের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর বিবাদ দীর্ঘদিনের।

ঢাকা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ওই চারটি ঘাট ঢাকা জেলা পরিষদ ইজারা দিয়ে থাকে। এসব ঘাটের মালিকানা ঢাকা জেলা পরিষদের। কাগজপত্র যদি বিআইডব্লিউটিএর হয়, তাহলে মালিকানা তাদের হবে।

ঘাটগুলো নিয়ে বিরোধ থাকায় আমরা উন্নত যাত্রীসেবা দিতে পারছি না। দেখা গেল, ঘাটে আমরা বিনিয়োগ করলাম, কিন্তু ইজারা দিচ্ছে জেলা পরিষদ। সে কারণে আমরা রাজস্ব পাচ্ছি না। অথচ ক্ষেত্রটা আমাদের। ইজারাদার নিয়োগ দেয় তারা। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ থাকা ঘাটের একটা সুরাহা হওয়া জরুরি
বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত পরিচালক আরিফ উদ্দিন

আইনে কী আছে

বিআইডব্লিউটিএ বলছে, ১৯৫৮ সালের অধ্যাদেশ মতে, বিআইডব্লিউটিএর অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে ফেরিঘাট, লঞ্চ ও খেয়াঘাটের উন্নয়ন করা। তা ছাড়া বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন বিধিমালা ২০১৯-এর আলোকে ঘাটে মালামাল ওঠানামা, স্থান ও স্থাপনা ব্যবহারের অনুমতি বিআইডব্লিউটিএ দিয়ে থাকে।

সংস্থাটি বলছে, পন্টুন স্থাপন, জেটি নির্মাণ, লঞ্চঘাটে যাত্রী ছাউনি তৈরি ও পন্টুনের উভয় পাশে ৫০০ গজ তীরভূমি নির্মাণের কাজও করে থাকে সংস্থাটি। তাই ইজারা দেওয়া ও রাজস্ব আদায়ের এখতিয়ার তাদের।

আরও যেসব ঘাট নিয়ে বিরোধ চলছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পূর্ব নাওডোবা লঞ্চঘাট। এটি ইজারা দিয়েছে শরীয়তপুর উপজেলা পরিষদ। চিলমারী লঞ্চঘাট ইজারা দিয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদ। এক সরা লঞ্চঘাট ইজারা দিয়েছে সাতক্ষীরা উপজেলা প্রশাসন। কালীবাড়ি ফেরিঘাট ইজারা দিয়েছে খুলনা জেলা পরিষদ। জেলখানা ফেরিঘাট ইজারা দিয়েছে খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ। কাস্টমস ঘাট ফেরিঘাট ইজারা দিয়েছে খুলনা জেলা পরিষদ।

চলতি বছরের মার্চে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে ঘাট ইজারা দেওয়া সংস্থার মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি সই হবে। এই সময়ের মধ্যে প্রতিটি সংস্থা এ নিয়ে চলমান নিজ নিজ মামলাগুলো নিজস্ব উদ্যোগে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ঘাটের দখল নিয়ে বিবাদে যাত্রীদের ভোগান্তি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা-গুপ্তছড়া ফেরিঘাটের কথা বলা যাক। এই ফেরিঘাটের ইজারা নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের বিবাদ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। যদিও এখন এই ঘাটের নিয়ন্ত্রণ চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের।

যাত্রীদের অভিযোগ, এই দুই সংস্থার বিরোধের কারণে সেখানে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হচ্ছে না। গত পাঁচ বছরে এই নৌ রুটে ছোটবড় দুর্ঘটনায় অন্তত ২২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। অভিযোগ আছে, যাত্রীদের নিরাপদ চলাচলে উদাসীন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ। প্রতিনিয়ত সেখানে যাত্রী হয়রানির খবর মিলছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী সাব্বির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশে এ ঘাট জেলা পরিষদের। এই ঘাটের পেছনে জেলা পরিষদের ৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়ে গেছে। এটি আমাদের প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে গেছে। এটি ছেড়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

যাত্রীদের সেবা না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যাত্রীদের সন্তুষ্টির বিষয়টি আপেক্ষিক। সেবা দিলেও কেউ বলবে না যে তারা খুশি। ভালোর কোনো শেষ নেই। তবে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ একমাত্র আদালতই সমাধান করতে পারেন বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।

আরও যেসব ঘাট নিয়ে বিরোধ চলছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পূর্ব নাওডোবা লঞ্চঘাট। এটি ইজারা দিয়েছে শরীয়তপুর উপজেলা পরিষদ। চিলমারী লঞ্চঘাট ইজারা দিয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদ। এক সরা লঞ্চঘাট ইজারা দিয়েছে সাতক্ষীরা উপজেলা প্রশাসন। কালীবাড়ি ফেরিঘাট ইজারা দিয়েছে খুলনা জেলা পরিষদ। জেলখানা ফেরিঘাট ইজারা দিয়েছে খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ। কাস্টমস ঘাট ফেরিঘাট ইজারা দিয়েছে খুলনা জেলা পরিষদ।

গত সপ্তাহে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বিআইডব্লিউটিএ বলেছে, সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে চলা এই বিরোধের কারণে দ্বৈত প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার বিরোধ থাকায় ঘাটের সংস্কার ও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হচ্ছে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের বিবাদের কারণে তৃতীয় পক্ষ লাভবান হচ্ছে। কিন্তু সরকার ও জনগণ কেউ লাভবান হচ্ছে না; বরং বিরোধ থাকার কারণে ঘাটগুলোতে কাঙ্ক্ষিত যাত্রী সুবিধা ও স্থাপনা নির্মাণ করা যাচ্ছে না। এ কারণে হয়রানি ও ভোগান্তি নিয়ে ঘাট পার হতে হয় যাত্রীদের।

বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত পরিচালক আরিফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘাটগুলো নিয়ে বিরোধ থাকায় আমরা উন্নত যাত্রীসেবা দিতে পারছি না। দেখা গেল, ঘাটে আমরা বিনিয়োগ করলাম, কিন্তু ইজারা দিচ্ছে জেলা পরিষদ। সে কারণে আমরা রাজস্ব পাচ্ছি না। অথচ ক্ষেত্রটা আমাদের। ইজারাদার নিয়োগ দেয় তারা। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ থাকা ঘাটের একটা সুরাহা হওয়া জরুরি।’