বাড্ডায় বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট বেনজীর পরিবার কিনেছে প্রতি বর্গফুট ২ হাজার ১৪২ টাকায়।
আদাবরে এক ভবনে ছয় ফ্ল্যাটের মালিক বেনজীরের স্ত্রী।
রূপগঞ্জে ২৪ কাঠার প্লট, দাম দেখানো হয়েছে প্রতি কাঠা মাত্র ১ লাখ ২ হাজার টাকা।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকায় আরও আটটি ফ্ল্যাটের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে ছয়টি ফ্ল্যাট ঢাকার আদাবরের একটি ভবনে। দুটি বাড্ডায়। রূপায়ন লিমিটেড স্কয়ার নামের ১৪ তলা ভবনে অবস্থিত বাড্ডার ফ্ল্যাট দুটি বাণিজ্যিক বা অফিস স্পেস।
বেনজীর পরিবারের নামে এ নিয়ে ঢাকায় ১২টি ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেল। এর আগে পাওয়া গিয়েছিল গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন গতকাল বুধবার নতুন করে খোঁজ পাওয়া বেনজীর পরিবারের আটটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। পাশাপাশি আদালত বেনজীর পরিবারের প্রায় ৭৬ বিঘা (২৫ একর) জমি জব্দ এবং বেসরকারি সিটিজেন টেলিভিশন ও টাইগার ক্রাফট অ্যাপারেলস লিমিটেডের শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন।
আদালত এর আগে দুই দফায় বেনজীর ও তাঁর পরিবারের নামে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কক্সবাজার ও ঢাকার সাভারে থাকা ৬২১ বিঘা জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার এবং গুলশানের ৪টি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দিয়েছিলেন। তখন ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব ও ৩টি বিও হিসাবও (শেয়ার ব্যবসার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
সব মিলিয়ে বেনজীর পরিবারের নামে জমি পাওয়া গেল ৬৯৭ বিঘা।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, বেনজীর পরিবারের সম্পদের অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে দুদক। এখন পর্যন্ত যেসব সম্পদ পাওয়া গেছে, তা জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
সম্পদ অনুসন্ধান চলার মধ্যেই বেনজীর আহমেদ গত ৪ মে সপরিবার দেশ ছাড়েন। তিনি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি এবং এর আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হিসেবেও দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।
মোহাম্মদপুরের পিসি কালচার হাউজিংয়ের একটি ভবনে খোঁজ পাওয়া ছয়টি ফ্ল্যাটের মালিকানা বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে। বাড্ডার ফ্ল্যাট দুটি বেনজীর পরিবারের কার নামে, তা দুদকের নথিতে উল্লেখ নেই। এ দুটির মোট আয়তন ৩ হাজার ৭৫ বর্গফুট। দলিলে এর দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ৬৫ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। ফলে প্রতি বর্গফুটের দাম পড়েছে ২ হাজার ১৪২ টাকা। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এত সস্তায় ঢাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনা তো দূরে থাক, আবাসিক ফ্ল্যাট পাওয়াও সম্ভব নয়।
বেনজীর পরিবার বাড্ডায় ফ্ল্যাট নিবন্ধন নিয়েছে ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, যখন তিনি র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।
বেনজীর আহমেদের সম্পদের বেশির ভাগই তাঁর স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে। বেনজীর চাকরিতে থাকার সময় তাঁর স্ত্রীর পেশা কী, সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। তবে বিপুল সম্পদ থাকার বিষয়টি সামনে আসার পর বেনজীর নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া ভিডিও বার্তায় দাবি করেছিলেন, তাঁর স্ত্রী ও মেয়েদের নামে মৎস্য খামার রয়েছে। তাঁর সম্পদ অপরাধলব্ধ নয় বলেও দাবি করেছিলেন তিনি।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় তাঁর মুঠোফোনে ও বাসায় গিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা হয়েছে। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি। একপর্যায়ে মে মাসের শুরুতে তিনি দেশ ছাড়েন। দুদক তাঁর সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গত ১৮ এপ্রিল।
বেনজীর পরিবারের নামে বান্দরবানে ইজারাকৃত ২৫ একর জমি পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আনন্দ হাউজিং সোস্যাইটিতে পাওয়া গেছে ৪টি প্লট, যার প্রতিটির আয়তন ৬ কাঠা করে মোট ২৪ কাঠা। এই জমি সাভানা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের নামে নিবন্ধন করা। দাম দেখানো হয়েছে সাড়ে ২৪ লাখ টাকা। ফলে প্রতি কাঠার দাম পড়েছে মাত্র ১ লাখ ২ হাজার টাকার কিছু বেশি।
বেনজীর পরিবার এই জমির দলিল করেছে ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। পরদিন তিনি অবসরে যান। স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘আনন্দ পুলিশ পরিবারকল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি’ আনন্দ হাউজিং প্রতিষ্ঠা করেছে। এটির নেপথ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন আবাসন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, আনন্দ হাউজিংয়ে প্রতি কাঠা ১০ লাখ টাকার কমে জমি নেই।
বেনজীর পরিবারের নামে ঢাকার উত্তরায় তিন কাঠা জমি ও তার ওপর স্থাপনা রয়েছে।
বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপর তাঁর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
বেনজীরের পরিবারের জব্দ করা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখভালে দুদককে ৬ জুন দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে তাঁদের যেসব কৃষিজমি রয়েছে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা দুটির কৃষি কর্মকর্তাদের। একই সঙ্গে বেনজীর আহমেদের পরিবারের মৎস্য ও প্রাণীর খামার দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলার প্রাণিসম্পদবিষয়ক কর্মকর্তাকে। কক্সবাজারের জমি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসককে।
বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের এসব সম্পদ থেকে যে আয় হবে, তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে-বিদেশে বেনজীর আহমেদের সম্পদের খোঁজ এখনো চলছে। যখনই যে সম্পদ পাওয়া যাচ্ছে, তা আদালতের নজরে আনা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া চলবে।