গ্যাং তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন কিছু শিক্ষার্থী। নিয়মিত মাদক সেবন, ছিনতাই-চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত এই গ্যাংয়ের সদস্যরা। সম্প্রতি এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনার পর এমনই একটি গ্যাংয়ের সদস্যদের পরিচয় সামনে এসেছে। ‘প্রলয়’ নামের এই গ্যাংয়ের সদস্যরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের (দ্বিতীয় বর্ষ) ছাত্র।
রাত যত গভীর হয়, প্রলয় নামের এ গ্যাংয়ের সদস্যরা ততই সক্রিয় হন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশুপার্কসংলগ্ন এলাকায় নিয়মিত মাদক সেবন করেন এই গ্যাংয়ের সদস্যরা। ক্যাম্পাসে তাঁরা সংঘবদ্ধভাবে চলাফেরা করেন। একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ। প্রতি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা চিকিৎসাকেন্দ্রের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে তাঁরা আড্ডায় মিলিত হন। সেখানে তোলা ছবিও তাঁরা ফেসবুকে পোস্ট করেন।
গতকাল শনিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের সামনে স্যার এ এফ রহমান হলের এক ছাত্রকে মারধর করে রক্তাক্ত করার ঘটনায় জড়িত ছিলেন প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ ঘটনার পর প্রলয় গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের এ গ্যাং বেশ কিছুদিন ধরেই গভীর রাত পর্যন্ত ক্যাম্পাস ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরে বেড়ায়। রাতের ক্যাম্পাসে বহিরাগত ব্যক্তিদের ছিনতাই-চাঁদাবাজি, হেনস্তাসহ নানা অপকর্ম করে বেড়ান সংঘবদ্ধ এ গ্যাংয়ের সদস্যরা। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন তাঁদের কেউ কেউ।
প্রলয় গ্যাংয়ের বিষয়টি গণমাধ্যমের খবর থেকে জানতে পেরেছি। খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তথ্যপ্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবেএ কে এম গোলাম রব্বানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রলয় নামের এ গ্যাংয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের তবারক মিয়া ও সিফরাত সাহিল; হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের অর্ণব খান ও আবু রায়হান; শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের হেদায়েতুন নূর ও মাহিন মুনাওয়ার; মাস্টারদা সূর্যসেন হলের তৌসিফ তাহমিদ ওরফে অর্পণ ও নাজমুল হোসাইন; জগন্নাথ হলের প্রত্যয় সাহা; কবি জসীমউদদীন হলের সাদ; আরও আছেন তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র সাদমান তাওহিদ ওরফে বর্ষণ; ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সৈয়দ নাসিফ ইমতিয়াজ ও তাহমিদ ইকবাল ওরফে মিরাজ; ইতিহাস বিভাগের বদরুজ্জামান সজীব; মার্কেটিং বিভাগের বিপ্লব হাসান ওরফে জয় ও মোহাম্মদ শোভন এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগের শাহ আলম৷ তাঁদের মধ্যে প্রথম তিনজন গতকাল রাতে স্যার এ এফ রহমান হলের এক ছাত্রকে মারধরের নেতৃত্বে ছিলেন। আর তৌসিফ তাহমিদ ও নাজমুল হোসাইন সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক৷ গতকালের ঘটনার পর থেকে এই গ্যাংয়ের সদস্যদের ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না৷
না কারণে পরে কেউ কেউ প্রলয় গ্যাং ছেড়ে এসেছেন। এমন একজন ছাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম বর্ষের শুরু থেকেই ক্যাম্পাসে রাতে আড্ডা দেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠি। টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কার্জন হল ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা ছিল আমাদের আড্ডাস্থল। ... ভুল বুঝতে পেরে প্রলয় গ্যাং ছেড়েছি।’
প্রলয় গ্যাংয়ের সাবেক একাধিক সদস্য বলেছেন, প্রথম বর্ষের শুরুতে আবাসিক হলে ওঠার পর ‘গেস্টরুম’ থেকে প্রায়ই তাঁদের হলে না থেকে ক্যাম্পাস চেনার জন্য রাতে ঘুরতে যেতে বলা হতো। তাঁরা টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কার্জন হল ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় আড্ডা দিতেন। এভাবে রাতে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস গড়ে ওঠে। ঘুরতে ঘুরতে অন্য হলের সহপাঠীদের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়। প্রায়ই রাতে ক্যাম্পাসের সড়ক দিয়ে যাওয়া মিনি ট্রাক আটকে তাতে করে হাতিরঝিল, ধানমন্ডি লেকসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতেন। সহপাঠীদের কেউ কেউ শুরু থেকেই মাদক সেবন, ছিনতাই-চাঁদাবাজিতে জড়িত ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তাঁরাও ধীরে ধীরে এসব অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। কিছু ‘বড় ভাই’ (ছাত্রলীগ নেতা) তাঁদের নানাভাবে উৎসাহ দেন। ছিনতাই-চাঁদাবাজির টাকায় মোটরসাইকেল ও দামি মুঠোফোন কিনেছেন গ্যাংয়ের কয়েকজন।
প্রলয় গ্যাংয়ের সাবেক একাধিক সদস্য বলেছেন, প্রথম বর্ষের শুরুতে আবাসিক হলে ওঠার পর ‘গেস্টরুম’ থেকে প্রায়ই তাঁদের হলে না থেকে ক্যাম্পাস চেনার জন্য রাতে ঘুরতে যেতে বলা হতো। তাঁরা টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কার্জন হল ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় আড্ডা দিতেন। এভাবে রাতে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস গড়ে ওঠে।
নানা কারণে পরে কেউ কেউ প্রলয় গ্যাং ছেড়ে এসেছেন। এমন একজন ছাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম বর্ষের শুরু থেকেই ক্যাম্পাসে রাতে আড্ডা দেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠি। টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কার্জন হল ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা ছিল আমাদের আড্ডাস্থল। কয়েকজনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমরা মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ি। একটা পর্যায়ে রাতে ক্যাম্পাস এলাকায় বহিরাগত কিংবা কোনো যুগলকে দেখতে পেলে তাঁদের নানাভাবে হেনস্তা ও মারধর করা শুরু করে আমার কিছু সহপাঠী। আমাদের আগে কিছু বড় ভাই (ছাত্রলীগ নেতা) একই ধরনের কাজ করতেন। তাঁদের সঙ্গেও আমাদের সখ্য তৈরি হয়ে যায়। তাঁরা আমাদের নানাভাবে উৎসাহ দেন, আমাদের সঙ্গে তাঁদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। ভাইদের যেকোনো প্রয়োজনে কিংবা বিপদ-আপদে আমরা দল বেঁধে গিয়ে উপস্থিত হই। আমাদের জুনিয়র ব্যাচের যাঁরা রাতে ঘুরে বেড়ায় এবং একটু উচ্ছৃঙ্খল, আমাদের সঙ্গে আবার তাঁদের একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়।’ ভুল বুঝতে পেরে প্রলয় গ্যাং ছেড়েছেন বলে জানান ওই ছাত্র।
জানতে চাওয়া হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, প্রলয় গ্যাংয়ের বিষয়টি গণমাধ্যমের খবর থেকে জানতে পেরেছেন। তথ্যপ্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁরা খোঁজখবর নিচ্ছেন।