কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছেন জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া (সাদা শার্ট ও সাদা প্যান্ট পরা)। গত বছর ১৮ জুন মুক্তি পান তিনি। কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছেন জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া (সাদা শার্ট ও সাদা প্যান্ট পরা)। গত বছর ১৮ জুন মুক্তি পান তিনি। কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

জল্লাদ শাহজাহানের বয়ানে জেলজীবনের অজানা কাহিনি

নাম তাঁর শাহজাহান ভূঁইয়া। তবে ‘জল্লাদ শাহজাহান’ নামেই পরিচিত তিনি। গত সোমবার তিনি মারা গেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘কেমন ছিলো জল্লাদ জীবন’ প্রকাশিত হয় গত বইমেলায়। কৌতূহলী পাঠকের জন্য সেই বইয়ের বিশেষ অংশগুলো তুলে ধরা হলো কিছু প্রাসঙ্গিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে।

শাহজাহান ভূঁইয়ার নাম আলোচনায় আসে কুখ্যাত অপরাধী এরশাদ শিকদারসহ বাংলা ভাই এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করার জন্য। নিজের হিসাবে ‘জল্লাদ’ হিসেবে মোট ৬০টি ফাঁসি কার্যকর করেছিলেন তিনি। তবে সরকারি হিসাবে সংখ্যাটা ২৬।

বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ায় শাহজাহানের সাজা হয়েছিল ১৮৪ বছর। পরে আপিল করে সাজা কমে আসে ৪২ বছরে। তবে তিনি কারাভোগ করেছেন ৩২ বছর। গত বছর কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। পরে তিনি কেরানীগঞ্জের গোলাম বাজারে একটি চায়ের দোকান দিয়েছিলেন।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ১০ জুন সাভারের হেমায়েতপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকতে শুরু করেছিলেন শাহজাহান ভূঁইয়া (৬৬)। গত রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে বুকে ব্যথা শুরু হলে তাঁকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তিনি মারা যান।

শাহজাহান তাঁর কারাগারে থাকার দিনগুলো নিয়ে একটি আত্মজীবনী লিখেছেন। চলতি বছর অমর একুশের বইমেলায় কিংবদন্তী পাবলিকেশন প্রকাশ করেছে জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়ার আত্মজীবনী ‘কেমন ছিলো জল্লাদ জীবন’। সেই বইয়ের কিছু অংশ প্রাসঙ্গিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তুলে ধরা হলো:

প্রথম কারাবাস

শাহজাহান ভূঁইয়ার জন্ম ১৯৫৮ সালে নরসিংদীর পলাশে। তিনি এইচএসসি পাস করে সেনাবাহিনীতে সিপাহি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তবে সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ম ও পরিশ্রম তাঁর ভালো লাগত না। তাঁর জেলজীবন শুরু হয়েছিল সেনাবাহিনীর নিয়ম ভঙ্গের জন্য। সেটা ১৯৮১ সালে।

সেনাবাহিনীর সদস্য থাকার সময় ছুটি না নিয়েই ব্যারাক ছেড়ে বাড়িতে চলে যান শাহজাহান। ফিরে আসার পর সামরিক আদালতে বিচারে তাঁর এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তাঁকে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। শুরু হয় তাঁর জেলজীবন। এখানেই তাঁর জীবন বদলে যায়। চোর-ডাকাত বিভিন্ন অপরাধীদের সঙ্গে মেলামেশা করে তিনি অন্ধকার পথে পা বাড়ান।

জল্লাদের সঙ্গে দেখা

কারাগারে প্রবেশের দ্বিতীয় দিনেই কোনো এক জল্লাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল শাহজাহানের। তিনি লিখেছেন ‘আমদানি ওয়ার্ডের পাশে একটা জায়গায় রশিদ নামের এক লোক থাকে। জেলখানার কয়েদিরা তার সেবাযত্ন করে, খাবার এনে দেয়। এটা দেখে আমার বেশ কৌতূহল জাগল। জানতে চাইলাম কে ইনি? একজন বলল, উনি এখানকার প্রধান জল্লাদ।’

‘জল্লাদ’ কাকে বলে, তা অবশ্য শাহজাহান জানতেন না। পরে কয়েদিদের কাছ থেকেই জল্লাদ বিষয়ে আদ্যোপান্ত জেনেছিলেন। তাঁর কাজ ছিল ‘কার্পেট ধোপা’ হিসেবে। জেলখানার সব কার্পেট ধোয়া ও শুকানো ছিল এই ধোপাদের কাজ।

জেলখানার সম্বল, থালা-বাটি-কম্বল

জেলখানায় থাকার নিয়ম সম্পর্কে শাহজাহান বহু বিবরণ দিয়েছেন। সংক্ষেপ তা হলো কয়েদিদের সম্বল ছিল তিনটি সুতি কম্বল, একটি টিনের থালা এবং একটি বাটি ও একটি গ্লাস। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে চারজনকে নিয়ে একটি ফাইল (দল) করে বসে থাকতে হতো গণনার জন্য। এরপর সকালে একটি রুটি ও ১৪ গ্রাম গুড়। তারপর কাজ শুরু। বারোটায় গোসল। চৌবাচ্চা থেকে নিজের খাবারের থালা দিয়ে পানি তুলে গোসল। দুপুরে দুটি রুটি আর ডাল। তিনি লিখেছেন, ‘মোটা আটার রুটিতে বড়ো বড়ো পোকা খুঁজে পাওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।’ খাবারের পর বিশ্রাম। কেউ কেউ এ সময় একটু ঘোরাঘুরি করত। দুপুর দুইটা থেকে আবার কাজ শুরু। চলত বিকেল চারটা পর্যন্ত। বিকেলেই রাতের খাবার দেওয়া হয়। ভাতের সঙ্গে ভাজা মাছ, কোনো দিন মাংস বা নিরামিষ, সবজি। তরকারি থাকত ৫৮ গ্রাম। খাবারের পরে একটু ঘোরাঘুরি। সাড়ে পাঁচটার ঘণ্টা বাজলেই সেলে ঢুকে পড়া। আবার গণনা।

মানিকগঞ্জের আদালতে শাহজাহানের বিরুদ্ধে অস্ত্র রাখা, ডাকাতি ও খুনের চেষ্টায় মোট ৪২ বছর সাজার রায় হয়। তাঁর ধারণা ছিল, ফাঁসির আদেশ হবে। জেলগেটে বসে রায়ের কপি না পাওয়া পর্যন্ত উত্তেজনায় তিনি এক চাওয়ালার কাছ থেকে কাপের পর কাপ চা পান করেছেন। রায়ের কপি পাওয়ার পার যখন নিশ্চিত হয়েছেন ফাঁসি হয়নি।

এবার গণনা কতজন নতুন এল, কতজনকে আদালতে নেওয়া হয়েছে, কতজন খালাস পেয়েছে। কতজন নারী, কতজন পুরুষ। সব হিসাব মিলে গেলে তিনটি ঘণ্টা দেওয়া হয়। গণনা না মিললে আবার গণনা শুরু। হয়তো কোনো কয়েদি পালিয়ে যায়, হয়তো কোনো পুলিশের গণনায় ভুল হয়। হিসাব না মেলা পর্যন্ত চারজনের একটি ফাইল (দল) করে বসে থাকতে হয় সবাইকে। কখনো এমনও হয় যে সারা রাত চলে যায় গণনা শেষ করে হিসাব মেলাতে। কয়েদিদের বসেই থাকতে হয় ফাইল করে। যে সেলে কয়েদিরা থাকেন, তার এক কোণেই পাটের ছালার বেড়া দিয়ে প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করার ব্যবস্থা। পাশেই পানির চৌবাচ্চা। সেই চৌবাচ্চার পানি দিয়েই শৌচকর্ম এবং তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পান করা।

‘উপরি’ আয়ের কায়দা

জেলখানায় নানা রকম উপরি আয়ের ব্যবস্থা আছে বলে বইয়ে উল্লেখ করেছেন শাহজাহান ভূঁইয়া।

যাঁরা নিজের সাজার মেয়াদের অর্ধেকের বেশি কাটিয়েছেন কারাগারে তাঁদের বলা হয় ‘কনভিক্ট ওভারশিয়ার’। তাঁদের তত্ত্বাবধানেই থাকেন নতুন কয়েদিরা। নতুন কয়েদিরা ভালো ‘সিট’ ও একটু ভালো খাবারের জন্য এই কনভিক্ট ওভারশিয়ারের শরণাপন্ন হন। অর্থ বা বিড়ির প্যাকেট ‘সেলামি’ দিয়ে তাঁদের তুষ্ট করতে হয়। জেলখানায় বিড়ি খুবই মূল্যবান সম্পদ। অনেক সময় কয়েদিরা হাতেই একধরনের বিড়ি তৈরি করতেন। সাদা জর্দার পাতার সঙ্গে শুকনো বরইপাতার গুঁড়া মিলিয়ে পুরোনো কাগজে পেঁচিয়ে তৈরি করা এসব বিড়ির নাম ছিল ‘তরপা’।

জল্লাদ হিসেবে ‘হাতেখড়ি’

প্রধান জল্লাদের সাত থেকে আটজন সহকারী থাকেন। তাঁরা মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করার ব্যবস্থা করেন। কেমন করে তাঁর জল্লাদ হওয়া, সেই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘একদিন খবর পেলাম গফরগাঁও থেকে আসা নূর ইসলাম নামের একজন আসামির ফাঁসি হবে। ...যেহেতু এর আগে জল্লাদ দেখে আমার মনে জল্লাদ হওয়ার সূক্ষ্ম একটা বাসনা জন্মেছিল; আমি নিজেকে বেশ সাহসীও দাবি করতাম; সেই আগ্রহ আর সাহস থেকে আমি সহকারী জল্লাদ হিসেবে নাম লেখালাম। সেবারই প্রথম পাশে থেকে নূর ইসলামের ফাঁসির কার্যকর হতে দেখলাম।’ এভাবেই জল্লাদের কাজে ‘হাতেখড়ি’ হলো তাঁর।

শাহজাহান ভূঁইয়ার বই ‘কেমন ছিলো জল্লাদ জীবন’। তিনি কারাজীবনের নানা কথা তুলে ধরেছেন এই বইয়ে

অন্ধকার পথে

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে শাহজাহান ভূঁইয়া চাকরিতে আর ফেরেননি। বেকার অবস্থায় একপর্যায়ে তিনি ডাকাতি শুরু করেন। একপর্যায়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকার মুগদা এলাকায় এসে থাকতে শুরু করেন। প্রায় চার শ ডাকাতি করেছেন। তাঁদের দলে হাশেম মোল্লা নামের একজন স্নাতকোত্তর পাস ব্যাংক কর্মকর্তাও ছিলেন। তিনি ডাকাতির মালামালের হিসাব রাখতেন। একবার পাঁচদোনা এলাকায় তাঁরা গাড়ি থামিয়ে ডাকাতি করে মালামাল ভাগ করেছিলেন পাশের মসজিদে। যাওয়ার সময় ভুল করে তালিকাটি ফেলে যান। সেখানে ১৭ জনের প্রত্যেকের নাম ছিল। সেই সূত্রেই তিনি দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার হন।

গুলিস্তান সিনেমা হলে ‘দোস্ত দুশমন’ সিনেমা দেখে ঘরে ফিরে শাহজাহান যখন চিটাগং রোডে ডাকাতি করে নিয়ে আসা ঢাউস আকারে ক্যাসেট প্লেয়ারে ক্যাসেট চাপিয়ে ‘তুমি কি সেই আগের মতোই আছ...’ গানে বিরহবিধুর আমেজে ভাসতে শুরু করেছেন, অমনি দরজায় টোকা। বন্ধু বিল্লালের গলা, ‘কাজ আছে, দরজা খোল।’ দরজা খুলতেই দেখেন, বিল্লালের পেছনে উর্দি পরা পুলিশের দল।

জেলখানার নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ফাঁসির পর আমি দুই মাসের রেয়াত (সাজা মওকুফ) পাবো। কিন্তু দশ বছরের বেশি সাজা মওকুফ সাধারণত করা হয় না। যার কারণে আমার নামে মোট ছাব্বিশটি ফাঁসি দেখানো হয়েছে। তবে এটাও বাংলাদেশে একজন জল্লাদের জন্য সর্বোচ্চসংখ্যক ফাঁসি।
জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া

‘থানায় নিয়ে শুরু হলো রামধোলাই। পুলিশ সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের পেটাল বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে। এরপর লকআপে ভরে রাখা হলো’, লিখেছেন শাহজাহান। কয়েক দিন পর ঢাকা থেকে শিফট করার হলো নরসিংদী সেন্ট্রাল জেলে। সেবার প্রায় ৯ মাস পর জেল থেকে মুক্তি পান।

আবার শুরু করেন ডাকাতি। নরসিংদী কারাগারে থাকতেই ‘আরও কিছু চোর, ডাকাত, খুনির সাথে আমার পরিচয় হলো।’ এবার ডাকাতি বাসে বাসে। স্টেনগান ছেড়ে এখন তিনি রিভলবার চালাতে শুরু করেন। বাস ডাকাতিতে টাকা পাওয়া যেত বেশি। টিকিট কেটে যাত্রী হিসেবে বাসে উঠতেন। ‘লাভ লাইন’, ‘ডলফিন’—সব বাসে তাঁরা নিয়মিত ডাকাতি করতেন। শেষ ডাকাতি করেন ১৯৯১ সালে। মাদারীপুরগামী চন্দ্রা পরিবহনে।

‘ডাকাত সরদার’ থেকে ‘জেল সরদার’

মানিকগঞ্জের বাস ডাকাতি ও খুনের মামলায় শাহজাহানকে  প্রথমে ঢোকানো হয় মানিকগঞ্জ জেলে। এটি তাঁর তৃতীয় দফা কারাগারে যাওয়া। তিনি লিখেছেন, ‘জেলে ঢোকার পর জেল সর্দার বিশাল একটা লাঠি হাতে নিয়ে আমাদের সামনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ট্যাকা কত দিবি ক? আমি ভয় না পেয়ে উত্তর দিলাম, আমি কইলাম না! ...ট্যাকার কতা আমার সামনে কইয়েন না। অন্য কোনো কথা থাকলে কন। জেল সর্দার আর কথা বাড়ালো না। ততক্ষণে পুলিশ সুপার এসে আমার নামে হওয়া সব মামলার লিস্ট দেখা শুরু করলেন। যখন তিনি দেখলেন আমার নামে একটা-দুইটা না বরং ছত্রিশটা মামলা, তখন তিনি নিজেই মাথায় হাত দিয়ে বসলেন।’

মানিকগঞ্জ কারাগারে ১৭ জনের ট্রাক ডাকাত দলকে আনা হয়। এদের সাতজনের সঙ্গে শাহজাহান নিজের দলের চারজন মিলে ১১ জনের একটা দল তৈরি করেন। কয়েক দিন পর ঢাকা থেকে শাহজাহানের দলের আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করে মানিকগঞ্জের জেলে পাঠানো হয়। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম ছিল আলতাব। মানিকগঞ্জ জেলে আলতাব নামের অন্য একজন কয়েদি ছিলেন। শাহজাহান লিখেছেন, ‘ওই আলতাবের সঙ্গে জেলখানার তখনকার এসির টাকা-পয়সা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। আমার দলেও আলতাব নামে একজন ছিল। এসি সাহেব শত্রুতার জের ধরে সেই আলতাবরে আমাদের ডাকাতি এবং হত্যা মামলার কেসে ফাঁসিয়ে দিলেন।’

নতুন আসা আসামিদের সাথে যখন চুক্তি হতো, তাদের বলতাম, তুই টাকা দিবি মোট সাত হাজার, পাঁচ হাজার দিবি হাতে। আর দুই হাজার টাকা আলাদা করে একটা সিগারেটের প্যাকেটে ভরে দিবি
জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া

মানিকগঞ্জ জেলে দলবদ্ধ আসামিদের ২২ জনের আরেকটি ডাকাত দল ছিল। তারাই জেলে মাস্তানি করত। কয়েদিদের মারধর করা, খাবার খেয়ে ফেলা, এসব করত। একবার তারা জেলারকেও পিটিয়েছিল। ফলে কারারক্ষীরাও তাদের ঘাঁটাত না। শাহজাহানেরা তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ১১ জনকে ‘ধোলাই’ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। আগে থেকেই চুলার লাকড়ি এনে লুকিয়ে রেখেছিলেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সূচনা হয়েছিল জুয়া খেলার মধ্য দিয়েই।

শাহজাহান লিখেছেন, ‘আগের জেলের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানতাম যে জেলখানা কর্তৃপক্ষের থেকে কোনো কিছু আদায় করার মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে অনশন করা।’ অনশন করার পর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সেই ডাকাত দলের গ্যাংটিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সর্দারের পদ খালি হয়। পরে শাহজাহানকে সরদার করা হয়। সরদারের কাজই ছিল জেল নিয়ন্ত্রণে রাখা। নতুন আসা আসামিদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, আসামিদের খাবার কম দিয়ে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার জেলারদের দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। শাহজাহান লিখেছেন, ‘আমি খাবারের ব্যাপারটা বাদ দিতে চাইলাম। কারণ, কয়েক দিন খাবারের কষ্ট করে বুঝেছি যে আসামিদের কতটা কষ্ট হয়। জেলারকে বললাম, টাকা যত লাগে আমি ম্যানেজ করে দেব। তবে খাবারের জন্য কষ্ট দেওয়া যাবে না। জেলার আমার শর্ত মেনে নিলেন এবং পরদিন থেকে আমি হয়ে গেলাম মানিকগঞ্জ জেলের সরদার।’

এর পর থেকে কয়েদিদের খাবারের বরাদ্দ থেকে টাকা কাটা বন্ধ হলো। তাঁদের রুটির আকার আর গুড়ের পরিমাণ বাড়ল। এই টাকা পূরণ করলেন তিনি নতুন আসা আসামিদের কাছ থেকে টাকা তুলে। ‘রাইটার’ নামেও আসামিদের একটা পদ আছে। তাঁর কাজ হলো সরদারের হয়ে নতুন আসামিদের হিসাব রাখা। জেল সরদারের লাঠি থাকে। শাহজাহান রাইটারকে তাঁর লাঠি দিয়ে তাঁকেই নতুন কয়েদিদের মারধর করে টাকা আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে দেন। আরেকজনকে দায়িত্ব দেন দাগি আসামিদের পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানোর।

শাহজাহান বলেছেন, ‘নতুন ব্যবস্থায় সবারই লাভ হচ্ছিল। আগে যেখানে জেলাররা পনেরো দিনে আটশ-নয়শ করে টাকা পেতেন, সেখানে এখন তারা দুই হাজার-বাইশ শ করে টাকা পাচ্ছেন। যার ফলে জেলাররাও আমার কাজকর্মে বেশ খুশি ছিলেন। আস্তে আস্তে করে এভাবেই আমি পুরো জেলখানাকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসলাম।’

জেলখানায় শাহজাহানের বেশ ভালোই আয় হচ্ছিল। তিনি বিবরণ দিয়েছেন, ‘জেল সরদার হওয়ার সুবাদে নিজেও কিছু টাকা রাখা শুরু করলাম। নতুন আসা আসামিদের সাথে যখন চুক্তি হতো, তাদের বলতাম, তুই টাকা দিবি মোট সাত হাজার, পাঁচ হাজার দিবি হাতে। আর দুই হাজার টাকা আলাদা করে একটা সিগারেটের প্যাকেটে ভরে দিবি। যাতে করে কেউ জানতে না পারে। সবাই জানবে তুই টাকা দিছিস পাঁচ হাজার। অনেকে টাকা দিতে রাজি হতো, অনেকে হতো না। মেরেও যাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যেত না, তাদের শাস্তি হিসেবে টয়লেট আর পানির ট্যাংক সাফ করার কাজ দিতাম। আসামিদের কাছ থেকে যে টাকা সরাসরি জেলারদের হাতে তুলে দিতাম, সেখান থেকেও শতকরা ত্রিশ টাকা আমি পেতাম।’

এক বসায় ৭০ কাপ চা

মানিকগঞ্জের আদালতে শাহজাহানের বিরুদ্ধে অস্ত্র রাখা, ডাকাতি ও খুনের চেষ্টায় মোট ৪২ বছর সাজার রায় হয়। তাঁর ধারণা ছিল, ফাঁসির আদেশ হবে। জেলগেটে বসে রায়ের কপি না পাওয়া পর্যন্ত উত্তেজনায় তিনি এক চাওয়ালার কাছ থেকে কাপের পর কাপ চা পান করেছেন। রায়ের কপি পাওয়ার পার যখন নিশ্চিত হয়েছেন ফাঁসি হয়নি। তখন চাওয়ালাকে বলেছেন, কত কাপ হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘চাওয়ালা আমাকে বলল, আমি নাকি ছোট ছোট কাপের সত্তর কাপ চা খেয়ে ফেলেছি।’

ঢাকায় এসে প্রধান জল্লাদ

মানিকগঞ্জ থেকে নরসিংদী জেলে পাঁচ মাস কাটিয়ে আবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় শাহজাহানকে। সেখানে প্রথমে পান পাপোশ ধোয়ার কাজ। তারপর পান রাঁধুনির দায়িত্ব। জেলখানায় রাঁধুনির কাজটা খুব লাভজনক। তিনি লিখেছেন, ‘সব আসামির জন্য খাবার রান্না করা ছিল আমার প্রধান কাজ। মাসখানেক পর এগুলো করতে গিয়ে বেশ কিছু টাকাও ইনকাম করতে শুরু করলাম। জেলখানার খাবার খুব একটা সুবিধার না হওয়ায় আসামিরা টাকা দিয়ে আমার কাছ থেকে বাড়তি ভালো খাবার কিনত। প্রতিদিন এভাবে হাজার-হাজার টাকা ইনকাম হতে লাগল। রাঁধুনি হিসেবে ছিলাম প্রায় বছর পাঁচেকের মতো। এরপর এক জেলার এসে আমাকে ক্যাশ টেবিলের কাজ দিলেন। সেখানে অবশ্য ইনকাম করার খুব একটা সুযোগ ছিল না।’

১৮৪ বছর সাজা

শাহজাহান ভূঁইয়ার মোট সাজা হয়েছিল ১৮৪ বছর। তিনি লিখেছেন, ‘আমার মামলাগুলোর মধ্য থেকে মোট ছয়টার জন্য আমাকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে সাজা হয়েছিল ১৮৪ বছর। এরপর বারবার আপিল করায় সাজা কমে এল। শেষ ডাকাতি ও হত্যা মামলার জন্য ত্রিশ বছর এবং অস্ত্র মামলার জন্য ১২ বছর; মোট ৪২ বছরের সাজা বহাল রইল। বাকি মামলাগুলোতে খালাস পেয়ে গেলাম। এর মধ্যে এমন এমন কিছু মামলা ছিল, যেগুলো করা তো দূরে থাক, আমি কখনো নামই শুনিনি। পুলিশ কোথা থেকে এসব মামলার তথ্য পেয়েছিল, মামলাগুলো কে করেছিল, আমার জানা নেই। আমার আসামি কার্ডে মুক্তির তারিখ লেখা দেখলাম ২০৩৫ সাল।’

ফাঁসির রেকর্ড

শাহজাহান ভূঁইয়া বলেছেন, তিনি তাঁর নিজের হিসাবে ফাঁসি কার্যকর করেন ৬০টি। কিন্তু সরকারি হিসাবে ২৬টি উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘জেলখানার নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ফাঁসির পর আমি দুই মাসের রেয়াত (সাজা মওকুফ) পাবো। কিন্তু দশ বছরের বেশি সাজা মওকুফ সাধারণত করা হয় না। যার কারণে আমার নামে মোট ছাব্বিশটি ফাঁসি দেখানো হয়েছে। তবে এটাও বাংলাদেশে একজন জল্লাদের জন্য সর্বোচ্চসংখ্যক ফাঁসি।’

তাঁর আক্ষেপ

শাহজাহান ভূঁইয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ২০২৩ সালের ১৮ জুন। পরে তিনি কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকায় একটি চায়ের দোকান দিয়েছিলেন। তাঁর সারা জীবনের বড় আক্ষেপ ছিল কারাগারে প্রবেশ করার পর তাঁর বাবা কোনো দিন তাঁকে দেখতে যাননি। তবে মা মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখে এসেছেন। তিনি কারাগারে থাকতেই বাবা-মা মারা যান। তাঁদের জানাজায় অংশ নিতে পারেননি। বইটির শেষে তিনি আক্ষেপ করেছেন বাবা-মার কথা না শোনার জন্য। সেনাবাহিনীর চাকরিটা ছাড়ার জন্য। আক্ষেপ করেছেন নিজের একটি পরিবার না থাকার জন্য। আরও বলেছেন, ‘আমি চাই না কারও জীবন আমার মতো হোক, আমি চাই না কেউ তার জীবন থেকে দিন-রাত হারিয়ে ফেলুক চৌদ্দ শিকের পেছনে।’